মিসেস লিপিকা ঢাকার একটা স্কুল এ- কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত।তার স্বামী আলতাফ চৌধুরী প্রাইভেট কোম্পানির মধ্যম মানের কর্মকর্তা। মধ্যবিত্ত বললে ভুল হবেনা। মিসেস লিপিকার বিবাহের পাঁচ বছর পরে তাদের কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। তার নাম রাখা হয় সায়ান্হ। নাম টা খুব ইউনিক। আসলে লিপিকার সন্ধ্যা খুব ভালো লাগে। সন্ধ্যার মাঝে তিনি কেমন যেন একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ খুঁজে পান।পাখিদের ঘরে ফিরে যাবার গান যেন ভেসে আসে তার কানে। সুদর্শন যখন উড়ে যায় সন্ধ্যার বাতাসে তার মন যেন দোলে সুরের মূর্ছনায়। সন্ধ্যার প্রতি এত ভালোবাসা থেকেই হয়তো তার কন্যার নাম রেখেছেন সায়ান্হ। সায়ান্হ বড় হচ্ছে। তাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। বাবা-মা দুজনেই ঠিক করে মেয়ে কে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করবে।যথারীতি তারা সায়ান্হ কে নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে।সায়ান্হ তো মহা খুশি। স্কুলে যাবে সেই আনন্দ ধরে রাখতে পারে না।সারাক্ষণ স্কুলের বই, খাতা, ব্যাগ নাড়াচাড়া করে।স্কুলে তার বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে যায়। সায়ান্হ কে স্কুল থেকে ফেরার পর বাসায় সারাদিন এক ফুপুর কাছেই থাকতে হয়।বাবা-মার সাথে দেখা হয় সন্ধ্যায়।প্রতিনিয়ত এরকম চলতে থাকায় বাবা-মার সাথে তার একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবি হলে সন্তাদের যা হয় আরকি। বাবা-মার সাথে তার বেশি সময় কাটানো হয়ে ওঠে না। মা কলেজ থেকে ফিরে সংসারের কাজ নিয়ে ই ব্যাস্তহয়ে ওঠে। বাবা অফিসের ফাইল নিয়ে কাজ করে।শুধু বেলী ফুপুই তার সাথে খেলা করে। বেলী তার নিজর ফুপু না।সায়ন্হ কে দেখাশোনা করার জন্য তার দাদার বাড়ির গ্রামের থেকে বেলী কে আলতাফ চৌধুরী নিয়ে এসেছেন। বেলী সায়ান্হ কে খুব আদর করে। এসব কিছুর মধ্যে দিয়েই সায়ান্হ বেড়ে উঠেছে।
ইতিমধ্যে সায়ান্হের একটা ভাই হয়। সায়ান্হ ভাই হওয়া তে
অনেক খুশি হয়। কিন্তু তার এই খুশি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাবা-মা সকল আকর্ষণ ভাই এর দিকে।আর আদরে বেলী ফুপু সারাদিন তার ছোট ভাইয়ের পরিচর্যা করে। সায়ান্হের মনে হতে থাকে সবকিছুতেই যেন একটা ভাগ বসাচ্ছে তার ভাই।সায়ান্হ অবশ্য কিছু দিনপর কোচিং আর প্রাইভেট টিউশন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে যায়। এগুলো নিয়ে ভাবার সময় আর তার কাছে নেই। তার ভাই স্কুলে পড়ার জন্য উপযুক্ত হয়েছে। বাবা -মা কপালে দুশ্চিন্তার ছায়া। তাদের ইচ্ছে ছেলে কে তারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এই খরচের বাজারে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়নো সম্ভব নয়।তাই তারা সাতপাঁচ না ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো সায়ান্হ কে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করার।সায়ান্হ খুব ই অখুশি হলেও তার বাবা -মার কাছে প্রকাশ করলো না।
একটাবাংলা মাধ্যম স্কুলে তাকে ক্লাস এইটে ভর্তি করা হল। সায়ান্হের নতুন স্কুলে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।একে তো সে চাপা স্বভাবের মেয়ে।অন্যদিকে তার বন্ধ -বান্ধবী সবাইকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল।কিন্তু সময় সবাই কে পরিবর্তন করে দেয়। সায়ান্হের ক্ষেত্রে এর ব্যাতিক্রম হলো না। গোটা পাঁচেক বন্ধ বান্ধবী হলো তার।এরইমধ্যে অর্ধ -বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। প্রথম পরীক্ষা দিন সায়ান্হ হলে গিয়ে দেখলো তাদের সিট পরেছে ক্লাস নাইনের সাথে। সায়ান্হ তার সিটে গিয়ে বসলো।পরীক্ষার শুরু হতে আর বিশ মিনিট বাকি হবে। শিক্ষক রা তখনো হলে আসেনি।এরমধ্যেই একটা ছেলে এসে চুপ করে সায়ান্হের পাশে বসে পরে।সায়ান্হ কিছু লক্ষ্যই করেনি।ও ব্যাস্ত ছিল বান্ধবীর সাথে কথোপোকথনে।মুখ ফিরাতেই যেন একটু অন্য রকম অনূভুতির জাগ্রত হলো।এদিকে স্যার হলে এসেছেন। খাতা দিয়েছেন।সবাই চুপচাপ নিজেদের খাতা নিয়ে ব্যাস্ত। পরীক্ষা শুরু।সবাই যার যার মতো পরীক্ষা শেষ করে বাসায় চলে গেলো।রাতে সায়ান্হ বাসায় পরবর্তী দিনের পড়া করছে।পরের দিন হলে গিয়ে দেখলো সেই ছেলেটা আগে এসে চুপ করে বসে আছে।হলে এখনো তেমন কেউ আসেনি। সায়ান্হ জ্যাম এর ভয়ে বাসা থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়েছিলো বলে আগেই এসেছে। সায়ান্হ ছেলেটার পাশে বসে পরলো। কেউ কথা বলছে না।কিন্ত দুজনেই বারবার একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে কিছুক্ষণ পর ছেলে টা বললো -
“তোমার নাম কি?
” সায়ান্হ”
” বা, ভারি মিষ্টি তো তোমার নামটা ”
সায়ান্হ একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
“তা আপনার নাম কী? ”
মেঘরাজ । তবে সবাই আমাকে মেঘ বলে ডাকে।
“মেঘ! মেঘ আমার খুব প্রিয়।জানেন আমি বারান্দায় বসে আকাশে মেঘের ভেলা খুঁজে বেড়াই।”
“তাই ”
এভাবেই শুরু হয় তাদের কথা। প্রতি পরীক্ষার এরকম কিছু না কিছু কথা হতো দুজনের মধ্যে। পরীক্ষার দিন গুলো শেষ হয়ে এলো। শেষ পরীক্ষার দিন মেঘ সায়ান্হ কে বললো,
” কাল থেকে আর তোমার সাথে তেমন দেখা হবেনা”
” কেন হবে না শুনি, আপনি চাইলেই হবে।”
বলে সায়ান্হ চলে গেলে।
পরীক্ষার পর স্কুল পনের দিনের জন্য ছুটি হলো।এই পনের দিনের মধ্যে এমন একটি দিন নেই যে সায়ান্হ মেঘরাজের কথা ভাবেনি। সায়ান্হের আকাশে মেঘের ভেলা খুঁজে বেড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। এখন তার মনে হয় দিনের বেশির ভাগ সময় আকাশটা মেঘলা থাকালেই ভালো। তার সময় যেন কাটে না।অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।আগে যে মেয়ে টি স্কুল বন্ধ দিলে আনন্দের কোনো সীমা পরিসীমা থাকতো না সে এখন স্কুল খোলার প্রতিক্ষায় দিন গুনছে। অবশেষে স্কুল খুললো।সায়ান্হ খুব উৎসাহ নিয়ে স্কুলে গেল। এই উৎসাহ অন্য কিছুর জন্য নয় শুধু মেঘরাজ কে দেখবার জন্য। স্কুলে ঢুকে নুতন বিল্ডিং সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে দেখে মেঘরাজ স্বয়ং দাঁড়িয়ে। সায়ান্হ একটু চমকে গিয়ে বলো
“আপনি এখানে? ”
“কেন তুমি প্রত্যাশা করোনি আমার? ”
” না, আসলে তা নয় ”
” তাহলে কি সায়ান্হ”
“আপনাদের ক্লাস তো অন্য বিল্ডিং এ হয়।”
“আমি তোমার জন্য এখানে এসেছি সায়ান্হ ”
“তাই বুঝি? তা আমার জন্য কেন?? ”
” এত কেন এর উত্তর আমার কাছে নেই ”
এদিকে ক্লাস শুরুর ঘন্টা বেজে উঠল।সায়ান্হ আর মেঘ দুজনেই ক্লাসে চলে গেল। এভাবেই প্রতিদিন স্কুল চলাকালীন কোন না কোন সময়ে তাদের দেখা হতো।দু চারটি কথাবার্তা হতো। প্রথম তিন মাস এভাবেই চলছিলো। আর সায়ান্হে মেঘরাজের প্রতি দিন দিন ভালো লাগা বেড়েই যাচ্ছে। খুব স্বাভাবিক মেঘের মধ্যে কেমন জানি একটা অন্য রকম অভিপ্রায় ছিল।স্কুলে মেঘের একটা আলাদা স্টাইল ছিল। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, মাথায় স্টাইল করে কাটা চুল,কাঁচা হলুদে রং এর মতো গায়ের চামড়া, আর মন ভুলানো কথার জাদু। যা সায়ান্হ ইতঃপূর্বে কোনো ছেলের মধ্যে খুঁজে পায়নি।সায়ান্হ নিজে ও অনুপম সুন্দরী। দুধে আলতার মতো গায়ের রং। দেবী দর্গার মতন আয়ত ও টানাটানা চোখ। কোমর পর্যন্ত কলো ঘন চুল।এক কথায় অপূর্ব। এর আগে বহু সুদর্শন ছেলে তাকে দেখে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সায়ান্হের মা-বাবা এত ছোট মেয়ে কে বিয়ে দিবে না বলে সেই সব প্রস্তাব অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়াও বহু স্মার্ট ছেলে দের আকর্ষণ ছিল আছে তার দিকে সে কিশোরী হলেও সবই সে বোঝে।হঠাৎ একদিন মেঘরাজ তার এক বন্ধু কে দিয়ে সায়ান্হের কাছে স্কুল ছুটির পর করিডরে একটু থাকার জন্য খবর পাঠায়।সায়ান্হ আনন্দে দিশাহারা। যথারীতি স্কুল ছুটি হলে সায়ান্হ করিডরে মেঘের জন্য অপেক্ষা করে। সে দূর থেকে দেখতে পায় মেঘ আসছে। যখন হাওয়া বয় সেই হাওয়া চঞ্চলতা সৃষ্টি করে আর সেই চঞ্চলতা সম্প্রসারিত হয় নীল আকাশের শঙ্খচিলের বুকে। ঠিক তেমনি সায়ান্হের কিশোরী মন শঙ্খচিলের মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। তবে সেই কথা আজ মেঘ তাকে বলবে যা ও এতদিন ধরে ভেবেছে। আরও কত ভাবনা অনু ভাবনা।এতটাই সায়ান্হ ভাবনায় মগ্ন ছিল যে, মেঘ কখন তার পাশে এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতেই পারতোনা যদি না মেঘ কথা না বলতো।
“এই সায়ান্হ কি ভাবছো?
” ও আপনি !, না কিছু না। ”
“আমি ছাড়া অন্য করো কথা ভাবছিলে নাকি? ”
“কি যে বলেন আপনি। কি জন্য আমাকে এখানে থাকতে বলেছেন? তাড়াতাড়ি বলেন বাসায় যাব।”
“আসলে অনেক দিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলবো ভাবছি “৷
” কী কথা? ”
” কথাটা হলো ইয়ে মানে। মানে”
“হেয়ালি কেন??, বলেন”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি ”
সায়ান্হ একটু মুচকি হেসে তার উত্তর টা দিয়ে দিল,
” আমিও আপনাকে ভালোবাসি”
মেঘ বলল,
“সত্যিই! তবে আজ থেকে আমাকে আপনি নয় তুমি বলবে।”
সায়ান্হ হা হা করে হেসে বললো
“আচ্ছা মেঘ, এখন থেকে আমি আপনাকে, তুমি বলবো ”
চাপা স্বভাবের সায়ান্হ যেন বেশ চঞ্চল হয়ে উঠে ছিল মেঘের স্পর্শে। যদি ও সায়ান্হের বাবা -মার চোখে তার চঞ্চলতা ধরা পরেনি। কিন্তু বেলী ফুপু যদিও শিক্ষিত ছিল না তবু নিজ হাতে পালন করা সায়ান্হের পরিবর্তন গুলো তার চোখে ভালো ভাবেই ধরা পরে। সায়ান্হের কাছে গল্পের ছলে কথা বার করার প্রয়াস ও বারবার চলায়। কিন্তু সেই প্রয়াস ব্যার্থ হয়।কিন্তু তাদের সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ বাড়তে থাকে।সায়ান্হ মেঘের সাথে স্কুলের করিডোর দাঁড়িয়ে পুরোটা টিফিন পিরিয়ডে সময় কাটায়। কখনো কখনো একে অপরকে টিফিন খাইয়ে দেয়।স্কুল ছুটির মেঘ রোজ সায়ান্হ পিছনে ছুটত।আরও কতোকিছু করতো।চিরাচরিত প্রেমিক -প্রেমিকারা যা করে থাকে আরকি।দিন যায়, মাস যায়, সায়ান্হর সে বেলী ফুপুর বিয়ে হয়ে যায় তার মায়ের কলেজর এক কেরানীর সাথে। সায়ান্হ বাসায় স্কুল থেকে ফেরার পর তার দশ বছরের ভাই কে নিয়ে একাই থাকে।ভাই কে এখন আর সে হিংসা করেনা। বেলী ফুপু বিয়ের দিন সায়ান্হ কে বলে গিয়েছিল ভাই কে আদর করতে। সায়ান্হ তাই করে।আর ফেসবুকে সারাক্ষণ মেঘের সাথে কথা বলে।যাইহোক এসব কিছুর মধ্যে মেধাবী সায়ান্হের ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয় না। ওদিকে মেঘরাজে র টেস্ট পরীক্ষার খারাপ হয়।স্কুল থেকে তাদের দুজনের বাবা-মা কে ডেকে পাঠানো হয়।স্যার- ম্যামরা তাদের বাবা মাকে তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে বলেন।তারা দুজনেই ধরা পরতে পরতে বেঁচে যায়। সায়ান্হের মা তার ফোন নিয়ে নেয়। আর ওদিকে মেঘ তার পরীক্ষা নিয়ে ব্যাস্ত।সায়ান্হ আর মেঘ দুজনেই আর আগের মতন সম্পর্ক রাখতে পারেনা। কেননা মেঘ আর স্কুলে আসেনা। বাসায় বসেই সে বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবু সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সপ্তাহে একবার কথা ও মাসে একবার করে দেখা তারা করতো। এভাবেই চলছে তাদের সম্পর্ক। আর এমন করেই দেড় বছর পার হল।সায়ান্হ তার মা’র কলেজ ভর্তি করা। তারা শান্তি নগরের ভাড়া বাসা ছেড়ে মিরপুর তার মা যেই কলেজে চাকুরি করেন তার পাশে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনলো। সায়ান্হ সব সময় এখন প্রবল চাপের মুখে থাকে।একে তো তার মাকে সবাই চিনে।তাকে আরও অনেক বেশি লেখা পড়ায় ব্ধ্যা হয়ে মনোযোগ দিতে হয়।আর মেঘের সাথে তার দুরত্ব বাড়ে।তবুও একবিংশ শতাব্দী তে ফেসবুকের কল্যাণে তাদের রোজ কথাবার্তা হতো। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হবার সুযোগ আগের মত হতোনা। সায়ান্হ সাথে প্রায় চার মাস মেঘরাজের দেখা হয়না। তারা ঠিক করে শুক্রবার দেখা করবে।অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটে। সায়ান্হ অনুপমা সুন্দরী বেশি সাজা তার নিষ্প্রয়োজন।মায়ের একটা নীল রঙের শাড়ি পরে, কপালে ছোট কালো টিপ,চোখ সমান্য কাজল, দিয়ে সাড়ে চারটায় বেড়িয়ে পরলো।এক বান্ধবীর জন্মদিনের কথা বলে।মা বুঝে মেয়ে বড় হয়েছে এটুকু ছাড়া যায় তাকে।বাসা থেকে বের হতে না হতেই আকাশ মেঘলা হতে শুরু করলো। সায়ান্হ রিক্সায় উঠে বসল।আর সেই মাএ প্রবল বর্ষণ শুরু হলো।সায়ান্হের মেঘলা আকাশ আগে থেকেই ভালো লাগতো।একটা রেস্তোরাঁর সামনে রিক্শা থামলো।দূরে থেকে সায়ান্হ সাদা পাঞ্জাবি পরা মেঘ কে দেখতে পেল। সায়ান্হ রিক্সা থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের ভিতরে গিয়ে বসলো। মেঘ তাকে দেখে বলল,
” বৃষ্টি জন্য আসতে কষ্ট হলো তাই না”
“আরে না। ”
” বাসা থেকে আসতে সমস্যা হয়নি? ”
” হয়নি আবার। সুমির জন্মদিনের কথা বলে এসেছি”।
” তা কি খাবে??”
” তা কিছু একটা হলেই হলো”
”
“তাই?? ”
“আচ্ছা মেঘ তুমি আমাকে এতগুলো মাস মিস করোনি?? ”
মেঘরাজ রাজ কপাল কুচকিয়ে বললো,
” হঠাৎ এই প্রশ্ন?? ”
” না এমনিতেই ”
“জানো সায়ান্হ তুমি যখন হাসো না তখন তোমার গালের ওই টোল টা খুব ছুঁতে ইচ্ছে করে। ”
সায়ান্হ হেসে বললো,
“তো ছোঁও না কে বারন করেছে। ”
বেলা হয়ে হয়ে গেল। তাদের সময়ও শেষ হয়ে গেছে। বাসায় ফিরে গেল দুজনেই। এভাবে তিন- চার মাস পর পর দেখা হতো আর ফেসবুকে কথাবার্তা হতো। মেঘরাজ ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে ‘ল’ কলেজে ভর্তি হলো।সায়ান্হের ইন্টার পরীক্ষার জন্য গত এক মাস কথাবার্তা হয়নি মেঘের সাথে। পরীক্ষা শেষ হলো আজকে। মায়ের আলমারি থেকে ফোন টা বের করেই সাথে সাথে ফেসবুকে ঢুকলো। খুবই মনোযোগ দিয়ে মেঘের
প্রোফাইল খুঁজেছে কিন্তু পাচ্ছে না। হঠাৎ সে দেখলো তাদের দুজনের পুরানো মেসেজের।উপরে লেখা ফেসবুক ইউজারস্। সায়ান্হের কিছু বুঝতে আর বাকি থাকলো না।
সায়ান্হ মেঘের ফোনে আনেক বার চেষ্টা করলো কিন্তু মেঘ ফোনে ও তাকে ব্লক করে দিয়েছে। সায়ান্হ হতাশ হয়ে কান্না শুরু করলো।অনেক কান্না করতে লাগলো।পাশের ঘর থেকে মা আসে পরলেন।বললেন,
“কিরে কি হয়েছে হঠাৎ করে কান্না করছিস কেন??”
সে মাকে কিছু বলতে পারলো না। কি বলবে সে মাকে। ওর মা মনে করেছে বেলী ফুপুর জন্য কান্না করছে। সায়ান্হ কয়েন সপ্তাহ মন খারাপ করে থাকলো। কোনো কিছু তার ভালো লাগতো না। সবই করতো বাধ্য হয়ে। তবুও দিন কার ও জন্য বসে থাকেনা। সময় তার নিজের গতিতে প্রবাহমান।সায়ান্হ খুব মেধাবী। অল্প পড়লেই তার অনেক পড়া হয়ে। এসব কিছুর মধ্যে তার পড়তে মোটেও ইচ্ছে করতোনা। তার রেজাল্ট বের হয়েছে। এবার সে রেজাল্ট ভালোই হয়েছে। সায়ান্হ অবশেষে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো। তার বাবা -মা অনেক খুশি। কিন্তু সায়ান্হ সব ভালো অনুভূতি গুলো যেন মেঘের সাথে তার জীবন থেকে চলে গেছে। সে তিন মাস হলো হাসতে ভুলেই গেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই তার বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু হলো। সে আই.বি. এ তে পড়ার সূত্রে বিভিন্ন প্রজেক্ট ও প্রেজন্টটেশন
এর কাজে তাকে নানা কোম্পানির কর্মকর্তা দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়।তার বেশির ভাগ সময়ে কাজ করতে হয় এ.আর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির প্রজেক্ট ম্যানেজার সায়েদ সামির তালুকদার এর সাথে।সামির সাহেব সায়ান্হ কে খুবই পছন্দ করেন। সায়ান্হ কে কোনো কাজের কথা একবারের বেশি বলতে হয়না। এ ছাড়া সায়ান্হ অনুপম সুন্দরী তাকে একবার দেখলেই নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে। সামির সাহেবের ক্ষেএেও এর ব্যাতিক্রম ঘটে নি। সে সায়ান্হ কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিল। সায়ান্হ সামির সাহেব কে তার সাথে মেঘের সমস্ত সম্পর্কের কথা জানান।।সামির সাহেব তার থেকে আট বছরের বড়। সে অনেক বেশি ম্যাচুয়েট তার কাছে এগুলো কোনো বিষয় না।সায়ান্হের মন জুড়ে শুধু মেঘের চলে যাওয়ার রিক্ততা। সুন্দর - অসুন্দর, ভালো -মন্দ এগুলো বিচার করার অবস্থায় সে নেই। সে শুধু মেঘের রিক্ততা যে কোন ভাবে পূরণ করতে চায়। তার আর এই অবস্থায় থাকতে ভালো লাগে না। সে সামির সাহেব কে জানিয়ে দিল, তাকে বিয়ে করতে হলে সামির সাহেব কে সায়ান্হের বাবা -মার সাথে আলোচনা করতে হবে।সামির সাহেব যথারীতি সায়ান্হ বাবা - মার সাথে কথা বললো।সায়ান্হের বাবা -মা সবকিছু ভেবে দেখলেন মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে তাছাড়া ছেলে বড় কোম্পানির কর্মকর্তা। মেয়ের সাথে কম বেশি পরিচয় আছে। ১৮ ডিসেম্বর সায়ান্হের বিয়ের তারিখ টিক করা হল।
আজ সায়ান্হের বিয়ে। আলতাফ চৌধুরী যতই মধ্যবিও হলেও একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো আয়োজনে ত্রুটি রাখেনি। লিপিকা তার প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়ে মেয়ের যাবতীয় গহনা ও আসবাবপত্র দিয়েছেন। আর আলতাফ সাহেব বাকি সব খরচ করে। বাড়ি আত্মীয় স্বজন দিয়ে গম গম করছে। বাড়ি জুড়ে বিয়ের আমেজ কিন্তু সায়ান্হের মনে সে আমেজ কোনো প্রভাব ফেললো না। তার মন জুড়ে শুধুই মেঘেরাজের চিন্তা। তাকে সাজানোর জন্য পার্লারে পাঠানো হলো। লাল শাড়ি,হাতে মেহেন্দি, পায়ে আলতা,এরকমই গায়ে দু -চারটাগহনা হালকা সাজ। সচারাচর বিয়ের কন্যা দের এমন হালকা সাজ দেখা যায় না। কিন্তু সায়ান্হ কে সে সাজে অন্য রকম লাগছিলো।সায়ান্হ কে কেমন লাগছে তা দেখার সময় তার নেই। সে এখনো ভাবছে মেঘের কথা।তার সাজ কার জন্য। সে তো শুধু মেঘরাজের হতে চেয়েছিলো। সে ভাবলো সে শেষ চেষ্টা করবে।যাতে জীবনের কোন এক পর্যায় যেয়ে নিজেকে অপরাধী মনে না হয়। সায়ান্হ পার্লারের একজনের ফোন নিয়ে মেঘ কে ফোন দিল। সায়ান্হ বললো,
” মেঘ প্লিজ তুমি ফোন টা কেটো না, আজ আমার বিয়ে। তুমি যদি এখনো আমার কাছে আসো, আমি সব কিছু ছেড়ে তোমার সাথে চলে যাব।”
ফোনের ওপার থেকে উত্তর এলো
” সরি সম্ভব নয় ”
সায়ান্হ যেন উত্তর টার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। সায়ান্হের মনে উত্তরের বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হলো না।বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।সায়ান্হ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার জীবনের সব কিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটতে থাকল। তার কারণে বিয়ে টা তার মনে কোন বিশেষ অনুভূতির জন্ম দেয়নি।এবার বিদায়ের পাল। বরের গাড়ি প্রস্তুত।সায়ান্হ গাড়ি তে ওঠা মাএ তার কান্নার পালা শুরু হলো। কোনো মেয়েই বোধ সেই সময়ে নিজেকে সামলাতে পারে না।বাবা-মা ঘর থেকে নতুন ঘরে যাওয়া।সায়ান্হের ক্ষেএে ও টাই ঘটলো। সায়ান্হ ধীরে ধীরে সংসারের সাথে পরিচয় ঘটেছে। স্বামী র প্রতি সব দায়িত্ব সেই পালন করছে। কিন্তু মেঘের কথা ভুলতে পরেনা কিছুতেই। সামির সাহেব সকালে অফিসে যাওয়ার পর একাই থাকে সায়ান্হ। সপ্তাহের তিন দিন ক্লাস করে। সায়ান্হ গৃহ কন্যার কাজ তেমন পারে না। মা কখনোই তাকে এসব কাজ করতে দেয়নি। সায়ান্হের গৃহ কন্যার কাজ করতে না পারার দারুণ তাকে প্রতিনিয়ত কথা শোনায় তার শাশুড়ী আর আন্ডার মেট্রিক ননদ। সায়ান্হের স্বামী এসব কিছুর প্র তিবাদ তো করেই না উল্টো সে সায়ান্হ কে বকাবকি করে। প্রথম দিকে সায়ান্হ এগুলো তেমন একটা গায়ে মাখতো না। কিন্তু দিন দিন তার প্রতি ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। তার স্বামী তার লেখা পড় বন্ধ করে দিতে চায়। এভাবেই তার সংসার জীবন অতিবাহিত হতে লাগলো।আরও এক বছর কাটলো। সায়ান্হ অনেক লড়াই করে তার লেখা পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। তার জীবন বলতে কিছুই থাকলো না।সব সময় তার স্বামীর কথায় উঠতে বসতে হতো। তার স্বামী যেন তার স্বকীয়তা হরণ করে রেখে। সামির সাহেবের নির্যাতনের মাএা দিন দিন বাড়ছে।তবু সে মেঘ কে ভুলতে পারছেনা। কোনো যোগাযোগ মেঘের সাথে তার ছিলো না। কিন্তু মেঘ যে আছে তার হৃদয়ের নিভৃত অন্তরালে তাকে ভোলা সায়ান্হের সম্ভব না। কিছুদিন পর সে জানতে পারে সামির সাহেবর একটা সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার আছে। সেটা হলো যে কোন কিছু তেই মাএাতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণতা আর যার জন্য তার আগের ওয়াইফের সাথে তার ডিভোর্স হয়েছিল। সায়ান্হ এগুলো কিছু ই জানতো না। তাও সায়ান্হ নিজেকে এক রকমএসব পরিস্থির সাথে মানিয়ে নিয়েছিলো। একদিন সায়ান্হের ক্লাস করে বাসায় ফিরতে দেরি হওয়ায় তার স্বামী তাকে নির্যাতন শুরু করে। তিন দিন খাওয়া বন্ধ করে রাখলো। শুধু তাই না তাকে বার বার শারীরিক নির্যাতনের করেছে। তার বাবা-এতদিন সায়ান্হ ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে যায়।বাবা -মা এগুলো জানলে কষ্ট পাবে ভেবেএতদিন তাদের কিছুই জানায় নি। সকালে সামির সাহেব র অফিসে গেলে ব। সে সাথে সাথে তার বাবার বাসায় চলে গেল। তার বাবা মা সব শুনে খুবই হতাশ হলো।সামির কে এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য সামির সাহেব কে ডাকা হলো। কিন্তু সামির সাহেব আসলেন না।
সায়ান্হ ঠিক করলো সে জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সে লেখা-পড়ায় মনোযোগ দিল অনেক বেশি। তবুও মাঝে মাঝে খুবই আপসেট হয়ে যেত। কিন্তু তার একদল ভালো বন্ধুরাই তাকে প্রেরণা যোগায়। দিন যায় মাস যায়, আর এভাবেই আরও দুটো বছর কেটে যায়। প্রকৃতি নিজের সাজে সেজে ওঠে। বসন্ত সাজিয়ে তোলে প্রকৃতি কে।কিন্তু সায়ান্হের মন জুড়ে শীতের রিক্ততা বিরাজ করে। সামির সাহেবের সাথে বিয়ে করে মেঘরাজের শূন্যতা পূরণ করতে চেয়েছিলো সে কিন্তু সেই শূন্যতা তো পূরণ হলোই না বরং আরও বহু গুনে বেড়ে গেছে। সামির সাহেবের সাথে তার দুই বছর ধরে সেপারেশন চলছে। এত কিছুর মাঝে খুশির একটা খবর পায় সায়ান্হ।অনেক ভালো রেজাল্ট করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের দারুণ আমেরিকার পাঠানো হবে। তার ভিসা প্রসেসিং শুরু হয়েছে। সামির সাহেব কে এই দুই বছরে বহু বার আলোচনার জন্য ডাকা হলে ও সে কোন সাড়া দেয়নি। সায়ান্হ ঠিক করলো সে সামির সাহেব কে ডিভোর্স দিবে। তার এক বন্ধুর মাধ্যমে উকিল ধরা হলো। ডিভোর্স এর দিন সায়ান্হ কোর্টএ গেল। তার উকিলের সাথে দেখা হলো। কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট আর উকালতি পোশাক পরা সেই মেঘ রাজ। মেঘরাজ ই তার উকিল। মেঘরাজ সায়ান্হের বন্ধুর কছে সব শুনে নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলো। সে একবার ও সায়ান্হের চোখের দিকে তাকালো না। আর সেই অপরাধ বোধ থেকেই বিনা ফিসেই সায়ান্হের ডিভোর্স করিয়ে দিলো।সায়ান্হ চার বছরের জন্য আমেরিকার চলে গেল।
সায়ান্হ আজ চার বছর পরে দেশে ফিরলো। কিছু দিনপর বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করলো। সায়ান্হ এখন কর্মব্যাস্ত। এখনো যখন সে বারান্দায় বসে বসে নীল আকাশে কালো মেঘ দেখে ঠিক তখনি তার বুকের বাপাশে রাখা স্মৃতির জোনাকি গুলো ঝিল মিল করে ওঠে। তার বহু যতেœর আবেগ দিয়ে গড়া ভালোবাসার উড়োজাহাজ টা আর মেঘের আকাশে পৌঁছাতে পারেনি। একদিন এমনই সময়ে তার ফোনে আন নোন নাম্বার থেকে একটা ফোন আসে। মেঘের ফোন। সায়ান্হ প্রত্যাশাই করেনি। মেঘ তাকে জানায় যে মেয়ের কারণে সে সায়ান্হ কে ভুলেগিয়ে ছিলো সে এখন লন্ডন প্রবাসী ছেলের সাথে বিয়ে করে লন্ডনে পারি দিয়েছে। আর মেঘের উকালতি ব্যবসার অবস্থা এখন বিশেষ ভালো না। সে সায়ান্হ কে আরও বলে সায়ান্হের অভিশাপের করনেই তার এই অবস্থা। কিন্তু সায়ান্হ আজও সব ফাঁকি জেনেও তার ঘরের জানালা খোলা রাখে, যাতে তার কাছে মেঘের নামে আলো আসে।
দূর থেকে ট্রেন আসার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তিন ঘন্ট অপেক্ষার অবসান ঘটলো। ট্রেন প্লাটফর্মে
এসে পৌছাঁলো। ম্যাডাম বললেন, “চলো সবাই ট্রেনে গিয়ে উঠি। “ম্যাডাম ও আমরা সবাই নিয়ন আলোর ল্যাম্পপোস্ট ঘেরা স্টেশন থেকে ট্রেনে গিয়ে উঠলাম। ডিপার্টমেন্টের তিন দিনের ট্যুর শেষে অবশেষে বাড়ি পৌঁছালাম।