দেশের নৌপথে প্রায়ই অন্য নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ছোট কিংবা বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছে। মূলত অন্য নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগেই দেশে সবচেয়ে বেশি লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকারি হিসাবে ২০২০ সালে ৩২টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৮১ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ১০ জন ও নিখোঁজ ১২ জন। তার আগের বছর ২০১৯ সালে ২৬টি দুর্ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যু, ২০ জন নিখোঁজ ও ৩৩ জন আহত হয়। আর ৩০ বছরে ৬০২টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭৩৫ জন মানুষ মারা গেছে ও নিখোঁজ ৫০১ জন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের পরিসংখ্যান মতে, বিগত ২০২০ সালে সারা দেশে ৭০টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওসব দুর্ঘটনায় ২১২ জনের মৃত্যু এবং আহত ও নিখোঁজ হয় আরো অন্তত ১০০ জন। আরেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, বিগত ২০১৯ সালে সারা দেশে লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকাডুবির ১১৬টি ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাক্কার কারণে ডুবে যায় ৪৪টি নৌযান। আর নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী বিগত ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৬০৮টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ২২৪টিই ছিল যাত্রীবাহী নৌযান। ওসব দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬৩৩ জনের মৃত্যু হয়। আর ওই সময়ে শুধুমাত্র লঞ্চ দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে নৌদুর্ঘটনার বিচার অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশের আওতায় হয়। কিন্তু আইনটি অত্যন্ত দুর্বল। ওই আইনে সর্বোচ্চ সাজা ৫ বছর। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নিসচা এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর দেশের নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য ৫টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে। তার মধ্যে দেশে ৪৩ শতাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনাই অন্য নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ঘটেছে। লঞ্চ দুর্ঘটনার দ্বিতীয় প্রধান কারণ অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণে মোট দুর্ঘটনার ২৫ শতাংশ ঘটেছে। তাছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৩ শতাংশ, আগুন ও বিস্ফোরণের কারণে ৬ শতাংশ এবং লঞ্চের তলা ফেটে গিয়ে বাকি ৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওসবের বাইরে যেসব কারণ দুর্ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে রয়েছে মানবসৃষ্ট ভুল, নৌরুট ও বন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, যাত্রীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব। তাছাড়া দেশের নৌ-রুটগুলোয় চলাচল করা নৌযানের ফিটনেস সনদ না থাকা, নৌ-চ্যানেলের প্রয়োজনীয় নাব্যতা ও প্রশস্ততা না থাকা, চালকের অদক্ষতা ও অনেক চালকের লাইসেন্স না থাকা, চালকদের নৌযান সংঘর্ষের ঘটনা প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকা, বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে চলাচল এবং অন্য নৌযানকে ‘ওভারটেক’ করার প্রবণতায় ধাক্কা লেগে লঞ্চ দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।
সূত্র জানায়, নৌ-দুর্ঘটনায় মালিক ও চালকরা দায়ী হলেও নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তরের বরাবরই তাদের পক্ষেই অবস্থান নেয়। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের কারণে গত কয়েক বছরেও অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ সংশোধন হয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আইনে রূপ নেয়নি। ওসব সংগঠনের অনুরোধে বারবার তাদের মতামত নেয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ করা হয়। শুধু তাই নয়, আইনে বারবার সাজা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও তা থেকে সরে আসা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে নৌ-দুর্ঘটনার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের বিধান রাখা হলেও চাপের মুখে তা আবার ৫ বছর করে নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তর খসড়া তৈরি করে। নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় ওই খসড়া নিয়ে এখনো কাজ করছে। সম্প্রতি খসড়াটির বানান সংশোধনের জন্য বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষে (বাবাকো) পাঠানো হয়েছে। সেটি ফেরত আসার পর নৌ-মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সাজার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আবার বসবেন। বিগত ২০১৫ সালে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। দফায় দফায় মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। ২০১৯ সালে খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সিরিজ বৈঠকে ১০ বছর সাজার বিষয়টিও মেনে নেয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা আবার ফিরিয়ে এনে এখন ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ ৫ বছর সাজার বিধান রাখা হচ্ছে। এমনকি এ সাজার বিধান এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
সূত্র আরো জানায়, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় মার্চেও নৌযান মালিকসহ স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকেও মালিকদের ৬টি সংগঠন বিভিন্ন অপরাধ ও বিধি লঙ্ঘনের জন্য বিদ্যমান সাজা আরো কমিয়ে জাহাজের আকার অনুযায়ী সর্বনি¤œ ২ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা এবং এক মাসের কারাদ-ের প্রস্তাব করেছে। তারা নৌযানের বয়সসীমা ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ বছর করারও প্রস্তাব করেছে। ওই বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন মতামত দেয়া হয়। তবে কোনো সংস্থাই বিদ্যমান সাজা বাড়ানোর পক্ষে মতামত দেয়নি।
এদিকে নৌ-দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে জানান, গত বছর মর্নিং বার্ড ডুবে যাওয়ার পর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটির প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। তবে বেশকিছু সুপারিশ প্রকাশিত হয়েছিল। যদি ওসব সুপারিশ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হতো তাহলে আর লঞ্চডুবির ঘটনাই ঘটতো না।
অন্যদিকে নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিআইডব্লিউটিএ প্রয়োজনীয় সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক জানান, অতিসম্প্রতি শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইব্লিউটিএ এবং নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ওসব কমিটির সুপারিশের আলোকে দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিতের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন এমন ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে তার সুপারিশ থাকবে। ওই সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
নৌ-দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আইন সংশোধনে বারবার সময়ক্ষেপণ ও সাজা কমানোর বিষয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চেšধুরী জানান, এমন কোনো আইন করা উচিত হবে না যা বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ করা যাবে না। এমন আইন করতে হবে যা প্রয়োগ করা যায়। যেহেতু আইন বাস্তবায়নের সঙ্গে মালিক ও শ্রমিকরা বেশি সম্পৃক্ত, পলে তাদের কথাও ভাবতে হবে। যাত্রী নিরাপত্তা, নৌপথের শৃঙ্খলা ঠিক থাকে এমন আইনই হচ্ছে।