দেশের পোলট্রি ও মৎস্য ফিড ভারতসহ নেপাল ও ভুটানের বাজারে প্রবেশ করতে পেরেছে। গুণগত মান ও তুলনামূলক কম খরচের কারণে এদেশের পণ্য জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখন রফতানি চালানের সময়ই প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্য দ্রুত পাঠাতে না পারলে বাজার হারানোর শঙ্কা রয়েছে। মূলত হেলথ সার্টিফিকেট ইস্যু নিয়ে সমস্যার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নিয়মানুযায়ী মৎস্য ও পশুখাদ্য রফতানির জন্য হেলথ সার্টিফিকেট জমা দিতে হয়। ওই সনদটি দেশ ভেদে ভিন্ন নামে চাওয়া হয়। কোথাও একে বলা হয় হেলথ সার্টিফিকেট, কোথাও স্যানিটারি সার্টিফিকেট বা ভেটেরিনারি হেলথ সার্টিফিকেট। ওই সনদ ইস্যু করতে একজন ভেটেরিনারি কর্মকর্তার দরকার হয়। কিন্তু মৎস্য অধিদপ্তরের পদটি নেই। ফলে মৎস্য অধিদফতর ফিস ফিড রফতানির হেলথ সার্টিফিকেট দিতে পারছে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে পোলট্রি ও প্রাণী খাদ্যের মাসিক উৎপাদন প্রায় ৪ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। তার বাইরে গ্রামে বা শহরগুলোতে অনানুষ্ঠানিকভাবে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টন ফিড উৎপাদন হচ্ছে। ওই হিসেবে প্রতি বছর দেশে ফিডের উৎপাদন প্রায় ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের শুরুতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান প্যারাগন ভারতের সেভেন সিস্টার্স হিসেবে খ্যাত সাত রাজ্যে রফতানির মাধ্যমে প্রথম চালানে প্রায় ১০০ টন পোলট্রি ফিড পাঠায়। ওই প্রতিষ্ঠানটি নেপালের বাজারেও পোলট্রি ফিড রফতানি করে। একই সাথে ভারতে রফতানি প্রক্রিয়া শুরু করে কোয়ালিটি ফিড ও নারিশ। আফতাব বহুমুখী ফিড কোম্পানিও প্রায় ১০০ টন মাছের খাবার রফতানি করে। সম্প্রতি ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সম্পন্ন হওয়ায় উদ্যোক্তারা সেদেশেও ফিডের বাজার আরো সম্প্রসারণের সম্ভাবনা দেখছেন। আর নেপালের সঙ্গে চুক্তি হলে সেখানেও ফিডের রফতানি বাড়ানো সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, ভারতের সাত অঙ্গরাজ্যসহ নেপাল ও ভুটানের বাজারে ফিডের চাহিদা আড়াই থেকে ৩ লাখ টন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান ভারতে প্রায় ৪০০ টন মৎস্য ও পোলট্রি খাদ্য রফতানি করেছে। আরো দুটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০০ টন রফতানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর স্বল্প পরিসরে নেপালেও রফতানি শুরু হয়েছে। নতুন চুক্তির কারণে ভুটানের বাজারেও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার ফিডের বাজারে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের একটি কোম্পানির সঙ্গে গত বছর ১০ হাজার টন মৎস্য খাদ্য রফতানির বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি করেছে। ওই চুক্তির আওতায় প্রথম চালানে ১০০ টন মাছের খাবার রফতানি করা হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) ভারতের ফিডের প্রথম চালানের হেলথ সার্টিফিকেট দিয়েছিল। সরকারি ওই প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার ও কার্যকর নীতিমালা রয়েছে। তবে নতুন নিয়ম অনুযায়ী ডিএলএস কেবল পোলট্রি খাদ্য রফতানির জন্যই সনদ দেবে। মৎস্য খাদ্যের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের সনদ দেয়ার দায়িত্ব। কিন্তু ওই অধিদপ্তরে মৎস্য খাদ্য রফতানি-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই। এমনকি সেখানে উন্নত মানের পরীক্ষাগারের অভাব রয়েছে। কোনো নীতিমালা, পরীক্ষাগার বা ভেটেরিনারি কর্মকর্তা না থাকায় মৎস্য খাদ্যের দ্বিতীয় চালানের জন্য হেলথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মোট কথা দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই চলতি মাসে মৎস্য খাদ্য রফতানির বাজার হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ চলতি বছর পরের চালান রফতানির উদ্যোগ নিতে গিয়েই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ‘মৎস্যখাদ্য বিধিমালা-২০১১’-তে সংশোধনী আনা হচ্ছে। সংশোধনীতে মৎস্য অধিদপ্তর তাদের ফিশ ইন্সপেকশন অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল (এফআইকিউসি) ল্যাব থেকে স্যানিটারি সার্টিফিকেট ইস্যু করার বিধান যোগ করেছে। তবে কোনো দেশ যদি স্যানিটারি সার্টিফিকেটের পরিবর্তে হেলথ সার্টিফিকেট চায়, সেক্ষেত্রে আবার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছেই যেতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, মৎস্য অধিদপ্তরেই প্রফেশনাল ভেটেরিনারিয়ান বা পশুচিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয় তার মাধ্যমেই সার্টিফিকেট ইস্যু করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে এখন ‘মৎস্যখাদ্য বিধিমালা-২০১১’ সংশোধন করা ও পশুচিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার কাজটি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবেসমস্যা সমাধানে মৎস্য অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছে। এদিকে মৎস্যখাদ্য বিধিমালা-২০১১ এর সংশোধনী বিষয়ে একটি সভা আহ্বান করেছে। সভার জন্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে কিছু দাবি জানানো হয়েছে। ওসব দাবির মধ্যে রয়েছেস্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৎস্যখাদ্য বিধিমালা সংশোধন ও অনুমোদন, মৎস্য অধিদপ্তরের এফআইকিউসি ল্যাবে প্রফেশনাল ভেটেরিনারিয়ান নিয়োগ, সংশোধিত বিধিমালা অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত রফতানিতে যেন কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সমন্বয় করা।
অন্যদিকে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ভারতের সেভেন সিস্টার্সে কয়েক দিনের মধ্যেই বৃষ্টিপাত শুরু হবে। বৃষ্টির পর পরই সাধারণত মাছের খাদ্যের চাহিদা বাড়ে। ফলে তার আগেই ওই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা মাছের খাদ্য আমদানি শুরু করে। ওই সময় ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য না পেলে শ্রীলংকা থেকে আমদানির উদ্যোগ নিতে পারে। শ্রীলংকা বা অন্য কোনো দেশের পণ্য ভারতে প্রবেশ করলে ওই বাজারে আবার বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়বে। সেজন্যই খাত সংশ্লিষ্টরা মৎস্য খাদ্য রফতানির জন্য স্বল্প মেয়াদে বিকল্প পন্থা প্রত্যাশা করছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি ও প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান জানান, দেশ রফতানির সম্ভাবনাময় একটি বাজারে কেবল প্রবেশ করেছে। দেশের ব্যবসায়ীদের এ উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও উন্নত করতে হলে সরকারের বড় ধরনের ভূমিকা প্রয়োজন। সেজন্য ফিড রফতানি বাজারে বাধাগুলো দ্রুত সমাধান করা এবং বন্দরগুলোতে অবকাঠামোর উন্নয়ন করা জরুরি। গ্রেন হ্যান্ডলিং টার্মিনাল করতে পারলে ফিডের পরিবহন খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশের অনুমতি নেয়া ও বাংলাদেশের রফতানি অনুমতি প্রক্রিয়াতে বেশকিছু জটিলতা রয়েছে। সেগুলো দূর করে রফতানির পথ সুগম করতে মন্ত্রণালয়ের আরো বেশি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।