অগ্নিকান্ড এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে? কেন এত দুর্ঘটনার শিকার ঢাকা? কারণ খুঁজলে উত্তর হলো ঢাকাতে অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বসবাস করে। অনেক অপরিকল্পিত ও অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় একটি ছয়তলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ভবনটির নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউন থাকায় আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় ৪ জন মারা গেছেন, ১৭ জন আহত হয়েছেন। ধোঁয়ার কারণেই বেশির ভাগ মানুষ অসুস্থ হয়েছেন। আহত ব্যক্তিরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর পূর্বে অনেক অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতার কারণও কেমিক্যাল গোডাউন। সরকার এই বিষয়ে কঠোর হওয়া সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না কেমিক্যাল গোডাউন। গত ১১ বছরে কোনো কেমিক্যাল গোডাউন সরানো হয়নি।
এ ছাড়াও বুধবার দুপুর আনুমানিক ১টায় তুরাগ এলাকার ৩ নম্বর রোডসংলগ্ন মোস্তফা মেম্বারের বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে প্রায় দেড় শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক লাখ টাকার মালামাল ও নগদ অর্থের। আগুন লাগার কারণ হিসেবে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই বস্তির সামনেই ফেলে দেয়া লেপ-তোশক ও ময়লা আগুনে পোড়ানো হতো। সেই ময়লা পোড়ানোর আগুন থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের এক সদস্য জানায়, বস্তির যে স্থানটিতে ময়লা পোড়ানো হতো সেখানকার বৈদ্যুতিক ত্রম্নটি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতু পরিবর্তনে তাই বাড়ে বা কমে তাপমাত্রা। দেশে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) রাজশাহীতে ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। যা চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ। এর আগে এ মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ২৬ মার্চ সীতাকুন্ডে ৩৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০০ সালে রাজশাহীতে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ১৯৪১ সাল থেকে বাংলাদেশে তাপমাত্রা রেকর্ড করা শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল- যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই বাড়ছে বা বাড়বে তাপমাত্রা। অগ্নিকা- নিয়েও বাড়বে শঙ্কা।
আরমানিটোলা ও তুরাগসহ কয়েকদিনের ব্যবধানেই ঘটে গেল কয়েকটি অগ্নিকান্ড। গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে প্রকৃতি থাকে উত্তপ্ত। ফলে এই সময়টা দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। কোথাও স্বল্প পরিসরে আবারও কোথাও বা ভয়াবহ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত বড় বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে তার সব কয়টিই বলা যায় রাজধানী শহর ঢাকাতে। ক্ষয়ক্ষতি যেমনই হোক না কেন আগুন কিন্তু সব সময় মারাত্মক। কারণ ছোট ছোট আগুনে মানুষ না পুড়লেও পুড়ছে মানুষের স্বপ্ন? ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের সব বিভাগ থেকে ঢাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি। পরিসংখ্যান সূত্রে, ২০১৯ সালে অগ্নিকা-ে মারা গেছে ১৮৫ জন। ২০১৮ সালে সারাদেশে ৮ হাজার ৪৬১টি আবাসিক ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে, এর ২০৮৮টি ঢাকায়, চট্টগ্রামে ২৮৫ ও রাজশাহীতে ১১৬টি। এসব ঘটনায় শুধু ঢাকায় প্রাণ হারায় ১২১ জন। আর এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার মতো। ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউএসএসএবি) ২০১৮ সালের ৩১ মার্চে দেওয়া তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ৬ বছরে অগ্নিকা- হয়েছে ৮৮ হাজার। এ অগ্নিকা-ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ১ হাজার ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু পোশাক কারখানাতেই হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে কাজ করে, তাই সেখানে আগুনে প্রাণহানির আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
অগ্নিকান্ড এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে? কেন এত দুর্ঘটনার শিকার ঢাকা? কারণ খুঁজলে উত্তর হলো ঢাকাতে অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বসবাস করে। অনেক অপরিকল্পিত ও অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে।
নতুন নতুন ইলেকট্রিক গ্যাজেট, ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জারসহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থের প্রাপ্যতা বেশি। তাই ঢাকায় অগ্নিকান্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। আগুন শুধু ঢাকাকেই পছন্দ করে, না আমি মনে করি, আগুনের পছন্দ অসচেতন জনগণ। সে ঢাকারও হতে পারে, হতে পারে বাংলাদেশ বা বহির্বিশ্বের। এই অসচেতন জনগণকে জানাতে হলে আগে আমাদের মনে রাখতে হবে বা জানতে হবে অগ্নিকান্ডের উপকরণ, কারণ ও এই ব্যাপারে কী কী সাবধানতা আমাদের নেওয়ার প্রয়োজন। সবার আগে বুঝতে হবে অগ্নিকান্ডের জন্য কী কী উপাদান কাজ করে। পড়ালেখা করাতে যেমন বই, খাতা, কলমের প্রয়োজন, একটি সংবাদ লিখতে হলে যেমন অসংখ্য তথ্যের প্রয়োজন তেমনি অগ্নিকান্ডও এমনিতে ঘটে না। যদি সেটা জানতে পারি, তাহলে সাবধান হতে সুবিধা হয়। অগ্নিকান্ডের অন্যতম উপকরণ হলো অত্যধিক তাপ, জ¦ালানি ও অক্সিজেন। চলুন জেনে নেই এগুলো কীভাবে অগ্নিকা- ঘটাতে সাহায্য করে। আগুন অথবা অত্যধিক তাপ হতে পারে সেটা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট অথবা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে। আগুন যদি নাও থাকে, অত্যধিক তাপ থেকেও কিন্তু অগ্নিকা- ঘটতে পারে। পুরান ঢাকায় একবার বিয়ে বাড়ির রান্নার তাপে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ঘরে রান্নাবান্নার ফলে অত্যধিক তাপ সৃষ্টি হয়েছিল। নিচে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি থাকায় সেটা আগুন ছড়িয়ে দেয়। আগুন জ¦লার পরে যদি আশপাশে জ¦ালানি থাকে, তবে সেটা সেই আগুনকে শক্তিশালী করে তোলে এবং সেটা ছড়াতে শুরু করে। কেমিক্যাল মজুত করে রাখলে কোনো অবস্থায় সেখানে এক স্ফুলিঙ্গ আগুনও যদি পৌঁছে, তাহলেই দাউ দাউ করে আগুন ছড়াতে শুরু করবে। পুরান ঢাকাকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ¦লতে পারে না। অনেকেই জানেন না, আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কাজ হচ্ছে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ফেলা। বদ্ধ ঘরের হাওয়ায় অক্সিজেন যদি না থাকে, আগুন দুর্বল হয়ে যায়। আপনি নিজেই গস্নাস উল্টো করে কাগজে আগুন ধরিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাই কেউ জানালার কাচ ভাঙার চেষ্টা করবেন না। তাহলেই পুড়ে মরবেন। একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, সেই ঘরে যেন মানুষ না থাকে। তাহলে অক্সিজেনের অভাবে তিনিও মারা যাবেন। এই হচ্ছে অগ্নিকান্ডের তিনটি উপকরণ।
অগ্নিকান্ডের অনেক কারণ আছে। বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ডের ধরন ও প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় যে, বেশির ভাগ অগ্নিকান্ডের কারণই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তাড়াহুড়ো করেই হোক আর খরচ বাচাতে গিয়েই হোক নিম্ন মানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সহজেই তা থেকে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগছে। পোশাক শিল্পে আগুন লাগার ক্ষেত্রে বিশেষত যে কারণটি লক্ষ্য করা যেতে পারে তা হলো কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ধূমপান করে। যখন বিরতি দেয়া হয় তখন অনেকেই এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে ধূমপান করে। এরপর যখন ঘণ্টা বা সাইরেন বাজে কাজে ফিরে যাওয়ার তখন অনেকেই হাতের সিগারেট বা বিড়ির অবশিষ্টাংশটুকু যত্রতত্র ফেলে দেয়। সেই রেখে যাওয়া সিগারেটের অল্প একটু আগুন ভেতরের তাপে আরো বেশি উত্তপ্ত হয় এবং একসময় ভয়াবহ আগুন হিসেবে সব জ¦ালিয়ে দেয়। মশার কয়েল থেকেও অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হতে পারে। আর ঘটমান এই অগ্নিকান্ডগুলো ভয়াবহ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণে উঠে আসে যে, শপিংমল কিংবা কারখানাগুলোতে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে সহজে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে না। কোনো এক ফ্লোরে আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে যদি অটো অ্যালার্মিং সিস্টেম চালু থাকে তবে অন্য ফ্লোরে অবস্থানরতরা আগেই স্থান ত্যাগ করতে পারে। এ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অন্তিম মুহূর্তে সবাই বুঝতে পারে আগুন লেগেছে। ফলে তারা দিশাহারা হয়ে পড়ে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে। আর বিল্ডিং তৈরির আইনটি তৈরি হয়েছে ২০০৬ সালে। ফলে অনেক ভবন অপরিকল্পিতভাবে আগে তৈরি, এসব ভবনে দুঘর্টনার সময় হতাহতের পরিমাণ বাড়ে। গলদ রয়েছে অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও। এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন? যান্ত্রিক এই কারণগুলো ছাড়াও অন্যতম কারণ হলো সাধারণ জনতার নিরক্ষরতা ও আগুনের বিষয়ে শিক্ষার অভাব। আমেরিকায় সাধারণ জনতাকেও আগুনের ব্যাপারে শিক্ষিত করা হয়। স্কুল-কলেজে শেখানো তো হয়ই, কর্মক্ষেত্রেও নিয়মিত ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা আছে বলে আমি জানি না। তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা নাই। ফলে আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করার সময় বা সুযোগ পায়। পরিণাম জানার পরও কোনো বিষয়ে গুরুত্ব না প্রদান করা খেলার শামিল বলেই ধরে নেওয়া যায়।
যে কোনো বিষয়ের কারণ ও করণীয় সেই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেই যৌক্তিকতায় অগ্নিকান্ডের কারণ ও করণীয় আমাদের সচেতন করবে এমনটাই প্রত্যাশা। পাশাপাশি সরকারও জনগণের নিরাপত্তার জন্য ফায়ার সার্ভিস বিভাগের আধুনিকায়ন করবে এবং অগ্নিকা- নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে এমনটাই আশা। অগ্নিকা- সবার জন্য বিপদজ্জনক তাই আসুন আগুণ নিয়ে খেলা বন্ধ করি।
গোপাল অধিকারী : কলাম লেখক