গত ৩ জুন বিকেলে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেট বাংলাদেশের ৫০ তম বাজেট এবং এ পর্যন্ত যতগুলো বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তার মধ্যে বিশাল আকার। এ বারের বাজেট ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার। এর মধ্যে আয় ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি ৬ দশমিক ১ শতাংশ। বাজেট ঘাটতির বড় অংশই আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে, ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে ব্যয় বাড়াতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সবাই আশা করেছিল সরকার বিদায়ী অর্থ বছরের বাজেট পুরোটাই বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদায়ী অর্থ বছরে ব্যয় করতে পারছে না বলে সংশোধন করতে হয়েছে।
‘জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটে জীবিকা বাড়ানোর সরাসরি কোনো কথা নেই। বরং ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ সুবিধার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন কর ছাড় পেরে ব্যবসায়ীরা উদ্যোগ বাড়াবেন, বাড়াবেন বিনিয়োগ। তাতে উৎপাদন বাড়বে, বাড়বে কর্মসংস্থান। এমন ধারনায় অর্থমন্ত্রী এমনটা করেছেন। কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, গত দু’বছরে করোনার দাপটে হোক বা অন্য কোনো কারনে হোক তেমন কোনো দেশীয় বা বিদেশী বিনিয়োগ হয়নি। কাজেই চলমান করোনার কারণে আগামীতে কতটা বিনিয়োগ হবে তা সময়ই বলবে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবার বাজেট প্রনয়নের ক্ষেত্রে তিনি গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি স্বাস্থ্যখাতকে সবচে অগ্রাধিকার দিয়েছেন বলছেন। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার প্রনোদনা তহবলি বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা। তৃতীয়ত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এরপর গুরুত্ব দিয়েছেন শিক্ষা খাত, দক্ষতা সহ মানব সম্পদ উন্নয়ন। পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসৃজন পঞ্চম অগ্রাধিকার খাত। সবশেষে আছে সামাজিক নিরাপত্তা সম্প্রসারন। অগ্রাধিকারে কথা যতই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পেচিয়ে বলা হোক না কেন বরাদ্ধ কিন্তু গতানুগতিক। সেখানে কোনো বিশেষত্ব নেই। অর্থমন্ত্রী এবারও বড় অংকের প্রবৃদ্ধির আলোচনায় আটকে থাকলেন। ৬ লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেট আর ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষমাত্রা অর্জনে উচ্চাভিলাষ বজায় রেখেছেন।
বাজেটের আগে ব্যবসায়ীদের বড় অভিযোগ ছিল সামগ্রিক কর ব্যবস্থা নিয়ে। সে সময় ব্যবসায়ীরা প্রচলিত কর ব্যবস্থাকে ব্যবসা বৈরী বলে আসছিলেন। এ থেকে উত্তরনে প্রয়োজন ছিল বড় ধরনের সংস্কারের। প্রনোদনা তহবিল দেয়া হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক খাতের সংস্কারের কথা ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেটে এ অর্থমন্ত্রীই বলেছিলেন। আবার কর জিডিপি নি¤œতম বলে সরকার নিজের অর্থে বড় আকারে প্রনোদনা তহবিলও দিতে পারে নি। সুতরাং কর ব্যবস্থার বড় সংস্কার প্রয়োজন। দক্ষিন এশিয়ায়, এমনকি প্রতিদ্বন্দী দেশ গুলোর তুলনায় বাংলাদেশের করপোরেট কর হার সবচে বেশি। দীর্ঘ-দিন থেকে ব্যবসায়ীরা এ হার কমাবার কথা বলছিনেন। গত বাজেটে এবং প্রস্তাবিত বাজেটে পর পর দু’বার আড়াই শতাংশ করে ৫ শতাংশ করপোরেট হার কমালেন। অর্থমন্ত্রী এবার স্থানীয় শিল্পকেও বড় ধরনের ভ্যাট ছাড় দিয়েছেন। গৃহস্থলি নানা ধরনের পন্যের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ভ্যাট ছাড়াও আগাম কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে দেশে উৎপাদিত মোবাইল ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতে। এদিকে করোনার কারনে দরিদ্রের হার বেড়েছে। নতুন গরিবদের বাজেটে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সার্বিক ভাবে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা বাজেট বিবেচনায় আনা হয়নি। বাজেট কাঠামো খুবই দুর্বল। বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে অনুমিতির ওপর ভর করে।
দেশে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার কথা বলে বাজেট শুরু করা হয়েছিল তার কোনো প্রতিফলন বাজেটে নেই। বরং ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধার কথাই ফুটে উঠেছে আদীপান্তে। তবে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন শোর গোল বা বিক্ষোত নেই। অর্থনীতি নিয়ে যারা গবেষনা করেন, তারাই শুধু আলোচনা করছেন বাজেট নিয়ে। বাজেট ভালো বা মন্ধ দিক নিয়ে তারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করছেন। কিন্তু জনগনের মাঝে এনিয়ে তেমন কোন আগ্রহ নেই। তবে সবাই বলছে, এ বাজেট ব্যবসায়ীদের খুশি করলেও সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে।