সমুদ্রে মাদার ভেসেল থেকে জ্বালানি তেল খালাসের পুরনো পদ্ধতি বদলের উদ্যোগ। সেজন্য সমুদ্রের তলদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে ডাবল পাইপলাইন। ফলে লাইটারিংয়ের বদলে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল মাদার ভেসেল থেকে সরাসরি পতেঙ্গার অয়েল বেল্টের প্রধান ডিপোতে চলে যাবে। তাতে লাইটারিং কাজে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) যে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হতো তার সাশ্রয় ঘটবে। বর্তমানে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বহির্নোঙ্গর থেকে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে তেল সরবরাহে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ। বিপিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে জ¦ালানি তেলের চাহিদার শতভাগ বিদেশ থেকে আমদানি হয়। কিন্তু একলাখ টনেরও বেশি ক্ষমতার মাদার ভেসেলযোগে আমদানিকৃত জ¦ালানি তেল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছে। তারপর ওই তেল লাইটারিং করে পতেঙ্গার অয়েল ডিপোতে নিয়ে আসা হয়। লাইটারিংয়ের কাজে বিপিসিকে বছরে গড়ে ৮শ’ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করতে হয়। এতো বিপুল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয়ে চীনের কারিগরি সহযোগিতায় এবং সরকারের যৌথ অর্থায়নে গভীর সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয়ে ডাবল পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। বিপিসির উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন ওই প্রকল্পের নাম হচ্ছে এসপিএম (ইনস্ট্রলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) উইথ ডাবল পাইপলাইন। ইতোমধ্যে ওই কাজের ৬৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। জ্বালানি তেল খালাসে ডাবল পাইপলাইন ছাড়াও গভীর সমুদ্রে মাদার ভেসেল থেকে সরাসরি তেল খালাসে একটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি সরকারের একটি মেগা প্রকল্প না হলেও সমুদ্র তলদেশ দিয়ে এ ধরনের দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণের বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং।
সূত্র জানায়, বিপিসি সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী আগামী বছরের শেষ নাগাদ সমুদ্র তলদেশে ডাবল পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হবে। তখন আমদানির জ¦ালানি তেল লাইটারিংয়ের আর কোন কার্যক্রম থাকবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) লাইটার জাহাজযোগে আমদানির জ¦ালানি তেল বহির্নোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে পতেঙ্গার অয়েল ডিপো ইস্টার্ন রিফাইনারি (ইআরএল), যমুনা অয়েল কোম্পানি লিঃ (জেওসিএল), পদ্মা অয়েল লিঃ (পিওএল) এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম কোঃ (এমপিসি)-এ নিয়ে এসে খালাস করা হয়। বিদেশ থেকে জ¦ালানি তেল আমদানির শুরুর পর্যায় থেকেই এ কাজ চলছে। কারণ বন্দর চ্যানেলে মাদার ভেসেল প্রবেশের সুযোগ নেই। কেননা তেলবাহী মাদার ভেসেলের ড্রাফট চ্যানেলের ড্রাফটের চেয়ে বেশি। যে কারণে মূলত বড় বড় মাদার ভেসেলকে বন্দরের বহির্নোঙ্গর অর্থাৎ কুতুবদিয়ার অদূরে নোঙ্গর করতে হয়। পরবর্তীতে লাইটার জাহাজযোগে জ¦ালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের খালাস কার্যক্রম চলে। জ¦ালানি তেলের ক্ষেত্রে লাইটারিং এককভাবে বিএসসির জাহাজ করে আসছে। তাতে করে এ কাজে বছর বছর যে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয় তা সাশ্রয়েই এসপিএম প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিপিসি। চীনা কারিগরি সহায়তায় এবং অর্থায়নে এ কাজ বর্তমানে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সমুদ্র তলদেশে স্থলভাগ মিলিয়ে ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই পাইপলাইনের ৬৩ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশে জ্বালানি তেলের যে চাহিদা রয়েছে তার ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতে হয়। আমদানির ওই তেল পিআরএলে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পরিশোধন করা যায়। অবশিষ্ট চাহিদার তেল অধিকতর অর্থ ব্যয় বিপিসিকে আমদানি করে আনতে হয় আর তার পুরোটাই সমুদ্র পথে। আসে লাইটারিং কাজে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করে বিপিসি পাইপলাইন প্রকল্পের উদ্যোগ নিলে বিগত ২০১০ সালে সরকার তাতে অনুমোদন দেয়। তারপর টেন্ডারের মাধ্যমে চায়না পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ওই কাজ পায়। সমুদ্র তলদেশে পাইপলাইনের ১৫৪ কিলোমিটার থাকবে। আর অবশিষ্ট ৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল পাইপ লাইন স্থলভাগে স্থাপিত হবে। বর্তমানে দেশে জ¦ালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। ওই তেল মাদার ভেসেল থেকে খালাস করতে যে সময় নেয়, পাইপলাইনের মাধ্যমে খালাস শুরু হলে তা অতি দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ২ দিনে একলাখ টন তেল খালাস হবে। ২৮ থেকে ৩০ ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন জ¦ালানি তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে পতেঙ্গার অয়েল ডিপোর সংরক্ষণাগারে পৌঁছে যাবে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে সমুদ্র যখন উত্তাল হয় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটে তখন তেল খালাস বন্ধ থাকে। পাইপলাইন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে ওসব প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।
এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, আশা করা হচ্ছে আগামী ২০২২ সাল নাগাদ পাইপলাইনের কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে আমদানির জ¦ালানি তেল জাহাজযোগে লাইটারিংয়ের পরিবর্তে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহের কাজ শুরু হলে জ¦ালানি খাতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।