ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায় বাদী বা রাষ্ট্রপক্ষের ওপর। মামলা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা যদি অভিযোগের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো সম্পৃক্ততা না পেয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেন।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংবাদপত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অসীম নয় বরং আইনি সীমারেখার মাধ্যমে এই স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়েছে। সংবাদপত্রে পরিবেশিত কোনো তথ্য যেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখন্ডতা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শালীনতা ও নৈতিকতাবিরোধী না হয় সে দিকে সংবাদিকদের খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদন যেন আদালতের অবমাননা না ঘটায় সে ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। তাছাড়া, আদলতে বিচারাধীন কোনো মামলার বিবাদমান বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সংবাদ পরিবেশন করা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু প্রায়শই আমরা লক্ষ্য করি যে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হলে সংবাদমাধ্যম অসাবধানতাবশত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রকৃত অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে ফেলে- যা কিনা অপরাধ আইনের অন্যতম মূলনীতি, যথা- 'অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আইনের চোখে নির্দোষ বলে বিবেচিত হবেন'- এর সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব বর্তায় বাদী বা রাষ্ট্রপক্ষের ওপর। মামলা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা যদি অভিযোগের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো সম্পৃক্ততা না পেয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেন।
ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অভিযোগের দায় থেকে আদালত কর্তৃক অব্যাহতি প্রদান করা হয়। অন্যথায় সম্পূর্ণ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর যদি রাষ্ট্রপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তাহলে আদালত সেই ব্যক্তিকে নির্দোষ ঘোষণা দিয়ে মামলা থেকে খালাস প্রদান করেন। কাজেই, বিচারাধীন মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দায়ী করে সংবাদ প্রকাশিত হলে অথবা গণমাধ্যমের কাছে প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রচারিত হলে- এরূপ সংবাদ বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে থাকে।
অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন কোনো বক্তব্য যদি পুলিশের কাছে দিয়ে থাকে, তা আদালতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রমাণে ব্যবহার করা যাবে না- এ-সংক্রান্ত বিধান ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ২৫ ধারায় বিদ্যমান রয়েছে। শুধু জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার শর্তাবলি মেনে যদি কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করা হয়, তবেই তা আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু তদন্তের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির দেওয়া বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হলে জনসাধারণের কাছে এই ধারণা জন্মায় যে, তিনি নিজে দোষ স্বীকার করেছেন তাই তার শাস্তি হওয়া উচিত। এ ধরনের তথ্য প্রচারিত হলে বিচারকদের পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং তাদের নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর ফলে সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত সুরক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) এ বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরপেক্ষ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত আদালতের মাধ্যমে বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
যখন কোনো সাংবাদিক বিচারাধীন মামলার বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করবেন তাকে অবশ্যই সাংবাদিকদের জন্য প্রযোজ্য পেশাগত আচরণবিধি ১৯৯৩ অনুসরণ করতে হবে। আচরণবিধির ১৬নং বিধিতে বলা আছে- বিচারাধীন মামলার চূড়ান্ত রায় এবং মামলার বিচার্য বিষয় সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা যাবে। তাছাড়া মামলার কার্যক্রম প্রভাবিত হতে পারে এমন কোনো মন্তব্য বা মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কোনো প্রতিবেদন বা লেখা আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে। কাজেই অভিযুক্ত ব্যক্তি কি আদৌ অপরাধী নাকি নির্দোষ এটি নির্ধারণ করবে আদালত, গণমাধ্যমে এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত বা আভাস দেওয়া যাবে না। বর্তমানে কিছু আইনে ভুক্তভোগীর নাম ও পরিচয় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ভিক্টিম বা ভুক্তভোগীর নাম-ঠিকানা প্রচারিত হলে, তাকে পরবর্তী সময়ে সমাজে পুনর্বাসন করার ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা ১৪(১) অনুযায়ী যৌন নির্যাতনের শিকার কোনো ব্যক্তির নাম প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে। ২০১৩ সালের শিশু আইনের ২৮ ধারায় অনুরূপ বিধান সংযোজন করা হয়েছে। কোনো মামলায় যদি ১৮ বছরের নিচে কোনো শিশু সম্পৃক্ত থাকে, তবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাকে শনাক্ত করা যায়, এমন কোনো তথ্য তার সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। যদি কোনো সাংবাদিক আপত্তিজনক কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তবে তার বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান, প্রেস কাউন্সিল বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা যাবে। তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বা সংবাদপত্রকে প্রেস কাউন্সিল পেশাগত নৈতিকতার বিধান অনুসরণে সতর্ক করতে পারে।
বিচার ব্যবস্থার ওপর মিডিয়া ট্রায়ালের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় সাংবাদিককে অবশ্যই পেশাগত আচরণবিধির পাশাপাশি ভিক্টিমের নাম প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত আইনি বিধান মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিল নিয়ম লঙ্ঘনকারী সাংবাদিকদের সতর্ক করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া, যদি কোনো সংবাদ প্রতিবেদন আদালতের নিরপেক্ষতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করে অথবা স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে, সেক্ষেত্রে আদালত অবমাননাজনিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এরূপ পরিস্থিতি প্রতিহত করা যেতে পারে।
ব্যারিস্টার আহমদ ইহসানুল কবীর : সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়