দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতেই (ইআরএল) অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল (ক্রুড অয়েল) পরিশোধন করা হয়। তবে চাহিদা অনুপাতে ইআরএল’র উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ২৫ থেকে ৩০ বছর আগেই ১৯৬৮ সালে স্থাপিত ওই শোধনাগারের যথানিয়মে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিবাহিত হয়ে গেছে। অথচ আজও দেশ ৫৩ বছরের পুরনো মেয়াদোত্তীর্ণ ইআরএল’র উপর একক নির্ভর হয়ে আছে। বিকল্প রিফাইনারি না থাকায় ৮০ ভাগ জ্বালানি তেলই দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা নেই। যে কারণে সরাসরি ফিনিশড বা পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি বাড়ছে। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ইআরএল’র জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি, কলকব্জা জোড়াতালি ঝালাই-সারাই-মেরামত চলছে। তাতে মেরামতের খরচ যোগ হয়ে তেল পরিশোধন ব্যয় বাড়ছে। ফলে বাড়ছে তেলের মূল্যও। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। সরকার এবং গ্রাহক জনসাধারণ খেসারত দিচ্ছে। অথচ চাহিদার সমপরিমাণ অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল আমদানি করে দেশেই পরিশোধন হলে দ্বিগুণ ব্যয় সাশ্রয় নিশ্চিত হতো। যার অঙ্ক বার্ষিক ৬ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে ডিজেল, কেরোসিন, এলপিজি, পেট্রোল, বিমান জ¦ালানি (জেট ফুয়েল), অকটেন, ন্যাপথা, বিটুমিন, ফার্নেস অয়েলসহ অন্তত ১৭ ধরনের জ¦ালানি তেল ও তেলের উপজাতের (বাই-প্রোডাক্ট) বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু ইআরএল’র সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। তার বিপরীতে উৎপাদন করছে মাত্র ১২ লাখ টন। যা চাহিদার মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও কম। অথচ বিশে^র কোনো দেশই একটি মাত্র রিফাইনারির উপর নির্ভর করে বসে নেই। বিগত ১৯৬৩ সালে দেশে তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম নগরী ও বন্দর লাগোয়া পতেঙ্গা গুপ্তখালে স্থাপিত ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ৫৩ বছরের পুরনো জরাজীর্ণ ইআরএল সংস্কার-মেরামত করে উৎপাদন প্রক্রিয়া কোনো মতে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), ইআরএল’র কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আমলারা দীর্ঘদিন ধরে ইআরএলে মেরামত বাণিজ্য’ চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ইধারএল কারিগরি মেরামত, জোড়াতালি, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ নানা উপায়ে অসাধু চক্র পকেট ভারি করছে। আর দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তেল শোধনাগারটি নিয়ে চলছে নানামুখী তেলেসমাতি। মেরামত বাণিজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাতিয়ে নিতে একটি চক্র নতুন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা ঠেকিয়ে রাখতে দীর্ঘদিন ধরেই মরিয়া হয়েই তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশে জ্বালানি তেলের পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ুক তারা তা চাইছে না। সেজন্য চক্রটি নেপথ্যে নানামুখী বাধা-বিপত্তি, জটিলতা তৈরি করছে। পাশাপাশি পরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহকারী (সাপ্লায়ার্স) ও তাদের এজেন্টরাও দেশে নতুন রিফাইনারি হোক তা চাচ্ছে না। কারণ সরাসরি পরিশোধিত বা ফিনিশড জ¦ালানি আমদানিতে এজেন্টদের বেশি লাভ। অপরিশোধিত (ক্রুড) আমদানি হলে তাদের ব্যবসা কমে যাবে।
সূত্র আরো জানায়, অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল পরিশোধন ব্যয় গত ১০ বছরের ব্যবধানে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মূল কারণ ৫৩ বছরের পুরনো ইআরএল’র ক্রমাগত মেরামত ব্যয়, অপচয়-অনিয়ম। কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী জ¦ালানি তেল পরিশোধন বা উৎপাদনে ২০০৯ সালে প্রতি টনে ব্যয় হয় ৬৩০ টাকা। ১০ বছর ব্যবধানে এখন টনপ্রতি খরচ ১২শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ইআরএল’র ১২ লাখ ৭১ হাজার টন তেল পরিশোধনে ব্যয় হয় ৮০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর ১০ বছর ব্যবধানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ লাখ ৬৬ হাজার টন তেল পরিশোধনে ব্যয় হয় ১৩৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ইআরএল’র কারিগরি সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২৫-৩০ বছর আগেই অতিবাহিত হওয়ায় একে সচল রাখতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সংস্কার, মেরামত, যন্ত্রপাতি পরিবর্তন ও সংযোজন করা হচ্ছে। আর মেরামতি খরচ যতোই বাড়ছে, তা সমন্বয় হয়ে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়ও।
এদিকে পরিশোধিত জ¦ালানি তেল আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে বাড়তি ব্যয় হ্রাস এবং অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন লাভজনক হওয়ায় সরকার ওই দু’টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ২০১০ সালে ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন প্রকল্প’ গ্রহণ করে। যার উৎপাদন টার্গেট ৩০ লাখ মেট্রিক টন। আর ইআরএল’র পুরনো ও নতুন ইউনিট মিলিয়ে ৪৫ লাখ টন অর্থাৎ দেশের মোট চাহিদার ৭৫ ভাগ পরিশোধনের লক্ষ্য ধার্য্য করা হয়। কিন্তু পদে পদে জটিলতা, অদৃশ্য বাধায় বিগত ১১ বছর যাবত জ¦ালানি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রকল্পটি ঝুলে আছে। এ যাবত দশ দফায় প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। আর গত ১০ বছরের দীর্ঘসূত্রতায় প্রকল্প ব্যয় প্রায় ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অথচ এখনো আর্থ-কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়নি। হয়নি নির্মাতা ঠিকাদার নিয়োগও। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ইআরএল-২ ইউনিট প্রকল্পে ইতোমধ্যে বিনিয়োগে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে সউদি আরব, চীন, আরব আমিরাত, ইউরোপ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের এনার্জি জায়েন্ট।
অন্যদিকে ইআরএল-২ ইউনিটের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক (পিএমসি) ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। বিগত ২০১৬ সালে ইআইএল’র সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিপিসি। যা ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্ধিত মেয়াদে বাড়তি মূল্য ১৮৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ১৯৬৮ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারির ডিজাইন বা নকশা তৈরি করে ফ্রান্সের কোম্পানি টেকনিপ। ২০১৭ সালে ইআরএল-২ প্রকল্পের নকশার কাজও টেকনিপকে দেয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পে টেকনিপের নকশা অনুসারে ভৌত অবকাঠামো কাজ ও যন্ত্রপাতি বসাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২২ কোটি টাকা। ইআরএল-২ ইউনিটে ১০টি প্রসেসিং ইউনিট রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে পরিশোধিত অবস্থায় পাওয়া যাবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেসঅয়েল, জেট এ-১, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার।
এ প্রসঙ্গে ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান জানান, ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পে নিয়োজিত ফ্রান্সের টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান টেকনিপ তথ্য-উপাত্ত সহকারে প্রস্তাবনা দিয়েছে। তার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করে ওই আলোকে একটি সারপত্র তৈরি হচ্ছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক (পিএমসি) ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ইআইএল) সঙ্গে তা সমন্বয় ও যাচাই করা হবে। শিগগিরই তা বিপিসিতে যাবে। তারপর আশা করা যায় প্রকল্পের কাজে আর দেরি হবে না। রিফাইনারি প্রকল্প স্থাপনের বিষয়টি জটিল ও হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। এদেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। সেজন্য সময় লাগছে।