বিদ্যমান করোনা মহামারীতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ই-কমার্স খাত অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। ফলে এ সময়ে ই-কমার্সের ব্যবসাও কয়েক গুণ বেড়েছে। আর এ খাতের প্রবৃদ্ধির কারণে পুরনোদের পাশাপাশি নতুন বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও চালু হয়েছে। কারণ ই-কমার্সের ওপর কভিডকালে পণ্য ও সেবা সরবরাহে ক্রেতা-বিক্রেতারা ভরসা রেখেছে। কিন্তু করোনাকালে দেশে ই-কমার্সের ব্যাপ্তি বাড়লেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ক্রেতা-গ্রাহক ধরতে আকর্ষণীয় ও অস্বাভাবিক অফার দেয়া বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিতর্কিত কার্যক্রম এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বিগত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের অনুমতি দেয়। তারপর গত এক দশকে ই-কমার্স খাতে ব্যবসার গ-ি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছে গেছে। বর্তমানে দেশে আনুমানিক ২ হাজার ৫০০ ই-কমার্স সাইট রয়েছে। আর দেড় লাখের বেশি ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরকেন্দ্রিক অনলাইনে ব্যবসার ৮০ শতাংশই পরিচালিত হচ্ছে তবে করোনাকালে খাতটি দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একং ই-ক্যাব সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে ই-কমার্স খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭৫ শতাংশ আর খাতটির আকার ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সাল নাগাদ এ খাতের আকার ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সেলফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রসাধনী, পোশাক, দুগ্ধজাত পণ্য, স্টেশনারি থেকে শুরু করে আরো নানা পণ্য ও সেবা বিপণন করছে। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ গোটা খাতটিকেই আস্থার সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। ই-কমার্স খাতে তিনভাবে লেনদেন হয়। কার্ড পেমেন্ট, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ বা ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতে। তার মধ্যে পণ্য হাতে পেয়ে অর্থ পরিশোধের ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিটি গ্রাহকদের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে কিছু কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের জন্য ক্যাশ অন ডেলিভারির পরিবর্তে কার্ড বা এমএফএসের মাধ্যমে অগ্রিম অর্থ নিয়ে থাকে। ওসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক তৈরির সবচেয়ে বড় কৌশল হলো বড় ছাড় বা আকর্ষণীয় উপহারের প্রলোভন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণারও অভিযোগ উঠছে। তার ধারাবাহিকতায় গ্রাহকরাও ই-কমার্স খাতের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিলেও সময় মতো পণ্য সরবরাহ করছে না। বরং দীর্ঘসময় ধরে ওই অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আটকে থাকছে। আর সময় মতো পণ্য না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে গ্রাহকরাও। ইতিমধ্যে রাজধানীর ভাটারায় একটি ই-কমার্স শপিংয়ের বাড়ি ঘেরাও করেছেন গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীরা। ওই সময় গ্রাহকরা তাদের পরিশোধিত অর্থ ফেরত দেয়ার দাবি জানায়। আর পণ্য সরবরাহকারীরাও প্রতিষ্ঠানটির কাছে তাদের বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া রয়েছে বলে দাবি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) ওই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। ওই প্রেক্ষিতে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। মূলত অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বড় ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য নিয়ে সময় মতো পণ্য সরবরাহ বা অর্থ ফেরত না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি গত বছরই ব্যবসা শুরু করেছিল। তাছাড়াও বিএফআইইউ আরো কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে দেশে ই-কমার্স খাত আস্থার সংকটে ভুগছে। যদিও ক্রেতাদের আস্থার সংকট কাটাতে ই-ক্যাব বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ই-ক্যাব সদস্যদের সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে জারিকৃত ই-কমার্স খাতের নীতিমালা মেনে ব্যবসা পরিচালনায় বলা হয়েছে। কারণ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হলে তা ক্রেতা-বিক্রেতা সবার জন্যই ইতিবাচক হবে। তাছাড়া ই-ক্যাবের সদস্য বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই ধরনের ৫টি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলতি মাসের শুরুতে ই-কমার্স নীতিমালা জারি করেছে। তাতে বলা হয়, অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোকে একই শহরের ভেতরে অগ্রিম অর্থ নেয়ার ৫ দিন এবং ভিন্ন শহর বা গ্রামের ক্ষেত্রে ১০ দিনের মধ্যে ক্রেতাদের কাছে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া সময় মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে ৭ দিনের মধ্যে মূল্য ফেরত দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ই-কমার্স কোম্পানিগুলো আগে থেকে ক্রেতাদের কাছ থেকে যে অগ্রিম মূল্য নিয়েছে, সেগুলোর পণ্য ডেলিভারি বা মূল্য ফেরতের ক্ষেত্রেও এই সময়সীমা কার্যকর হবে। যেসব ক্রেতা অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পরও পণ্য বা মূল্য ফেরত পাচ্ছে না, তাদের দ্রুত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে। আর পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারিম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে ক্রেতার কাছ থেকে অগ্রিম পণ্যমূল্য গ্রহণের ৫ দিনের মধ্যে পণ্যের ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে। তবে ক্রেতা ভিন্ন জেলা বা গ্রামে অবস্থান করলে মূল্য পরিশোধের ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর জানান, এদেশে ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনা অনেক। তাছাড়া করোনা মহামারীর সময় অনলাইনে কেনাকাটা করার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকাংশ পণ্যই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে কিনবে। ফলে ই-কমার্সের পরিধি আরো বাড়বে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের অঘটন ঘটলে মানুষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা হারাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পুরো খাতের ওপর পড়বে। জারি করা নীতিমালা ও নির্দেশিকা যদি মেনে চলা যায় তাহলে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা যাবে। তাতে করে ই-কমার্সের প্রতি ভোক্তার আস্থা বাড়বে। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান জানান, যেসব প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের পণ্য দিচ্ছে না বা মার্চেন্টদের পাওনা পরিশোধ করছে না তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভোক্তাদের ভোক্তা অধিকার আইনে ও মার্চেন্টদের প্রচলিত আইনে দ্রুত মামলা করা প্রয়োজন।