পলাশ চৌধুরী কলকাতার নামী ডাক্তার। দক্ষিণ কলকাতায় নিজস্ব ফ্ল্যাট গাড়ী কি নেই। একমাত্র ছেলে দার্জিলিং এর হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। স্ত্রী সুচরিতা সুন্দরী ও শিক্ষিতা। কলেজের প্রোফেসর। আপাত দৃষ্টিতে সুখী পরিবার। পলাশের বাবা মারা গেছেন আজ পঁচিশ বছর হল। বিধবা মা থাকেন শ্রীরামপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। ডাক্তার ছেলের অতবড় ফ্ল্যাটে তার জায়গা হল না।
আজ তিরিশে আষাঢ় পলাশের জন্মদিন। বাড়ী ভর্তি লোক। সব বন্ধু বান্ধব, স্ত্রীর বান্ধবীরা, তার বাপের বাড়ীর লোক এমনকি ছেলের ও কিছু বন্ধু উপস্থিত। হোটেল থেকে খাবার এসেছে। নেই শুধু মহামায়া দেবী, পলাশের মা। আজ পলাশের ভীষণ মায়ের কথা মনে জাগছে। গত বছর পলাশ আজকের দিনে মার কাছে আবদার রেখে ছিল বাড়ীটা তার নামে লিখে দেন যেন। মা নিজে হাতে পায়েস রান্না করে একবাটি পায়েস আর বাড়ীর দলিল টা নিয়ে পলাশের ঘরে ঢুকে ছিলেন। তারপর যতœ করে পায়েস টা খাইয়ে দিয়ে দলিলটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, তোর জন্মদিনের গিফ্ট। বাবা মারা যাবার পর থেকে প্রতি বছরই তাই করতেন মহামায়া দেবী। পলাশ ঘুম থেকে ওঠার আগেই পায়েস রেঁধে, পূজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে পলাশকে ডাকতেন, সঙ্গে থাকত একটা পছন্দ মতো গিফ্ট।
আজ পলাশের ভীষণ মায়ের কথা মনে পড়ছে। এই বছর সব আছে শুধু মা আর মায়ের রান্না পায়েস নেই। মায়ের দেওয়া গিফ্ট টা কে বিক্রী করেই তো এই ফ্ল্যাট কেনা সুচরিতার বুদ্ধিতে, যেখানে মায়ের জায়গা হয়নি।
বসার ঘরে সোফায় বসে এইসব চিন্তাই করেছিল পলাশ। হঠাৎ ফোনটা অসান্ত স্বরে বেজে উঠল। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে পেসেন্ট এসেছে, এক্ষুনিই যেতে হবে।
এখন ঠিক সন্ধ্যে ছটা, সেই সকাল দশটা থেকে পলাশ হাসপাতালে। একটা পেসেন্ট এসেছিল যাকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে পলাশ। বাড়ী থেকে এর মধ্যে ফোন এসেছিল বেশ কয়েকবার, নাহ পলাশ কথা বলেনি। পেশেন্ট কে ছেড়ে সে একবারও যায়নি।
সুচরিতা পলাশের জুনিয়ার তপোব্রতকে ফোন করে জানতে চেয়েছিল, "স্যার কখন ফিরবে ?"
"আমিও ঠিক বুঝতে পারছিনা ম্যাডাম, একজন বৃদ্ধা, বাসে কার টাকার ব্যাগ নিয়ে নেয়। পাবলিক ভীষণ মারধোর করে। পুলিস হাসপাতালে এনে ভর্তি করে দেন। বাঁচার আশাও নেই, অথচ স্যার সারাদিন না খেয়ে ঐ ভিক্ষারীটা কে সেবা করে যাচ্ছেন।" তপোব্রত জানিয়েছিলেন।
এখন রাত নটা পলাশ বাড়ী ফিরেছে। সব আত্মীয় বন্ধু সবাই চলে গেছেন। সুচরিতা খাবার টেবিলেই অপেক্ষা করেছিল। পলাশ ফিরতেই বলল, "খাবার গরম করি ? "
পলাশ বলল, "না খিদে নেই।"
-"সেকি ? শরীর খারাপ করেছে নাকি? সকাল থেকে কিছু খাওয়া নেই, অথচ খিদে নেই বলছ কেন ?"
- "আমি খেয়েছি সুচি।"
- "কোথায়?"
- "ঐ বৃদ্ধা ভিক্ষারী আমার জন্যেই পায়েস করে আনছিলেন। যে ছেলে তাড়িয়ে দিয়েছে, তার মঙ্গল কামনায় পায়েস রাঁধতে ভোলেনি আমার মা। ওনার সাথে থাকা ব্যাগটা পুলিশ হেপাজতে ছিল। আমি দেখতে চেয়েছিলাম। পায়েসের টিফিন পট টা খুলে মায়ের আশীর্বাদ টুকু আগে নিয়েছি। মাকে আমায় বাঁচাতেই হবে সুচি।"
-"হাসপাতালের সবাই জানে উনি তোমার মা ?"
-" নাহ খ্যাতির শিখরে বসে ওনাকে মা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করেছিল। তবে ভুল করেছি কাল গিয়ে পুলিশকে বলে আসব সব।"
সুচরিতা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে বলল,"আমায় ক্ষমা করে দাও পলাশ। সব আমার জন্য হয়েছে। আমিও কাল যাব মার কাছে ক্ষমা চাইতে। আমার পরিবারে ওনাকে ফিরিয়ে আনব। উনি ছাড়া এই পরিবার যে অসম্পূর্ন।"