বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম হতাশা বিরাজ করছে। ছাত্র-যুব-জনতার অধিকার আদায়ের কথা ভুলে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির রাঘব-বোয়ালখ্যাত শত শত রাজনৈতিক ব্যক্তি। যারা রাজনীতির নামে জনগনের সাথে প্রতারণানীতিই বজায় রেখেছে স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরে। যখন ক্ষমতায় এসেছে নিজেদের আখের গুছিয়ে আরাম-আয়েশের রামরাজত্ব তৈরি করেছে। যে কারণে একদল ক্ষমতায় থেকেছে, অন্যদল আরাম আয়েশে ঘরে বসে বসে সাধারণ মানুষের চেতনা-আবেগ-অনুভূতি নিয়ে অবিরাম মানুষ দেখানোর রাজনৈতিক কথা বলেছে। কেবল লোভ-মোহ-অপরাধ-দুর্নীতি-পরিবারনীতির রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বর্তমানে নির্মমতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তার উপরে করোনা টিকা নিয়ে অদ্ভুত এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশে। যদিও বন্ধ হয়ে যাওয়া টিকাদান কর্মসূচি এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। জাপানের কাছ থেকে উপহার পাওয়ায় প্রায় পনের লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েও অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে।
কিন্তু করোনার চিত্র পাল্টাতে পারে এমন গতির টিকাদান কর্মসূচি এখনও শুরু করা যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল এক সপ্তায় এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে। ঘটা করে প্রচারণা চলতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলে বসেন, ১১ই আগস্ট থেকে ১৮ বছরের বেশি বয়সী কেউ টিকা ছাড়া বাসা থেকে বের হলেই শাস্তি দেয়া হবে। যেন আলাদিনের চেরাগ পাওয়া গেছে। এক সপ্তায় আটাশ কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়ে যাবে। পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে তিনি বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।
নীতি-আদর্শ-সততার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্তাদের কারণে একের পর এক অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কোন কোন মন্ত্রী-এমপি-সচিব-আমলা-সরকারী কর্মচারি-নায়ক-নায়িকাণ্ডমডেল-অভিনেত্রী কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে জমানোর পাশাপাশি দেশের বাইরে একাধিক বাড়ি করছে, আর সাধারণ মানুষ অর্ধহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা পাচার করছে ছাত্র-যুব-জনতার অধিকার হরণকারী রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজরা। উন্নয়নের রোল মডেল-এর নামে মানুষের মৌলিক উন্নয়ন না করে ইটপাথরের উন্নয়নের নামে কিছু মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার রাস্তা প্রশস্থ হচ্ছে, তখন হেলেনা জাহাঙ্গীর, পরী মনি, পিয়াসা, সাহেদ, সাবরিনা, পাপিয়া, সম্রাট, জিকে শামীম, পঙ্কজ দেবনাথ, নূরন্নবী চৌধুরী শাওন, খালেদরা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে বলে অভিযোগ উঠছে; গণমাধ্যম বলছে- ‘তারা অপরাধী।’ কিন্তু এই অপরাধীদেরকে কেউ থামানোর চেষ্টা করছে না, কেবল লোভের লেলিহান আগুনে তেল দিয়ে যাচ্ছে, ধাও ধাও করে জ্বলছে সেই আগুনে বাংলাদেশ। সাজানো নাটকে-আটকে করোনাকাল ক্রমশ সহায় সম্বলহীন হয়ে উঠছে।
এই সময়ে হুট করেই এক সপ্তাহের কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। সাত দিনের পরিবর্তে এখন এক দিন এ কর্মসূচি পালিত হবে। মূলত টিকার পর্যাপ্ত মজুত না থাকার কারণেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে।তিনি বলেন, সবকিছুই নির্ভর করছে সময়মতো টিকা পাওয়ার ওপর। এতে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংযুক্ত থাকবে। কর্মসূচির মূল লক্ষ্য বয়স্কদের টিকার আওতায় আনা। কারণ তাদের মধ্যে টিকা নেওয়ার প্রবণতা কম এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেশি। তবে বয়স্কদের পাশাপাশি অন্যরাও টিকা পাবেন। তিনি বলেন, এখনই ১৮-ঊর্ধ্ব সবাইকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে না। এই টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে অবশ্য বহু প্রশ্নেরই জবাব মিলছে না। হাজার হাজার মানুষ রেজিস্ট্রেশন করে টিকার অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের টিকা না দিয়ে ৭ই আগস্টের জন্য কেন অপেক্ষা করা হল তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। দ্বিতীয়ত, টিকার পর্যাপ্ত মজুত যদি নাই থাকে সপ্তাহ ঘিরে কেন এই ব্যাপক প্রচারণা চালানো হলো। যদিও গ্রামে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ যদি লাইনে দাঁড়িয়ে যেতো তাদের কি টিকা দেয়া যেতো? সেটা নিয়েই চলছে নানা আলোচনা। এই আলোচনা-সমালোচনার জন্য দায়ী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ করোনা সংশ্লিষ্ট ৯ মন্ত্রণালয়ের সচিব-মন্ত্রী-এমপি-সরকারী কর্মচারিদের অধিকাংশ। সেই দুর্নীতিবাজদের কারণে করোনাকালে মানুষ দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে উত্তরণের একটিই পথ, আর সেটিই হলো-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সকল মন্ত্রী-এমপি-সচিব-সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরকে যুদ্ধে নামকেত হবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে-সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে। সেই ভালোবাসায় কোন খাদ থাকা চলবে না।
৩৩৩ তে কল দিলে যেন আর কোন জসীম অথবা রহিমাকে বাসায় গিয়ে হুমকি দেয়া না হয় এই করোনাকালের খাদ্যসহায়তার পরিবর্তে। সেই কথাটা মাথায় রেখে করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার জন্য শিল্প খাতে বড় দুটি প্রণোদনা প্যাকেজের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর যে ঘোষণা এসেছে, সেই ঘোষণা অনুযায়ী অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতি থামানোর কর্মযজ্ঞ হাতে নিতে হবে বাংলাদেশের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এরইমধ্যে অবশ্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের জন্য আরও ৫৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংককে জোগান দেওয়া হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাদ্দ তহবিলেও পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। সেখান থেকেও অর্থ দেওয়া হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে আলাদাভাবে দুটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে চলতি অর্থবছরের জন্য প্রতিটি ব্যাংককে এসব খাতের জন্য আলাদা আলাদা লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ওই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বড় শিল্প ও সেবা খাতে ঋণ দিতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দেওয়ার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এসব অর্থ বিতরণ করতে হবে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় গত বছরের এপ্রিলে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী বড় শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন। এর আলোকে গত বছরের ১২ ও ১৩ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি সার্কুলার জারি করে দুটি তহবিল গঠন করে। এর মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের ঋণের সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। আর গ্রাহক দেবে সাড়ে ৪ শতাংশ এবং ব্যাংককে ভর্তুকি হিসাবে দেওয়া হবে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ। পরে দুই দফায় এ তহবিলের আকার বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে জুন পর্যন্ত ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ তহবিলটি বাস্তবায়ন করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রাহককে দিতে হবে ৪ শতাংশ এবং ব্যাংককে ভর্তুকি হিসাবে দেওয়া হবে ৫ শতাংশ। এ তহবিল থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ তহবিলটি বাস্তবায়ন করছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব তহবিলের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৫ হাজার ১০ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। এ দুটি তহবিলের মধ্যে বড় শিল্পের ১৫ হাজার কোটি টাকার তহবিলের বড় অংশই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের তহবিলের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশির ভাগই ব্যবহৃত হয়নি।
এই সময়ে এসে বলা হচ্ছে- করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিমুখী শিল্পকে সহায়তা করতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আকার দুই দফায় বাড়িয়ে ৫৫০ কোটি ডলার এবং সুদের হার কমিয়ে পৌনে ২ শতাংশ করা হয়। এ তহবিলের প্রায় শতভাগ ব্যবহৃত হয়েছে। গত জুনে এ তহবিলে ২০ কোটি ডলার ছিল। তা থেকে এখন ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এটি ঘূর্ণায়মান তহবিল। অর্থাৎ ঋণের অর্থ সুদসহ ফরত এলে তা আবার তহবিলে জমা হয়। এভাবে এ তহবিলে প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি ডলার জমা হচ্ছে। এসব থেকেও এখন ঋণ দেওয়া হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হয়। ঋণের মেয়াদ সাধারণত ৩ থেকে ৬ মাস। করোনার কারণে এর মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। রপ্তানিকারকদের চাহিদা থাকলে এ তহবিলের আকার আরও বাড়ানো হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিলের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়েছে। এর মেয়াদ এখনো বাড়ানো হয়নি। ওই সময় পর্যন্ত এর প্রায় ৮৬ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলে এখন অবশ্য জানানো হয়েছে। এই তথ্য নিয়েও শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। করোনা পরিস্থিতিতে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে এসেছে প্রায় ৫ কোটি মানুষ। তাদের জন্য ভাবতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের রাজনীতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে। যাতে করে দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাস্থ্য-সমৃদ্ধিতে না থাকলেও কিছুটা হলেও আশ্বস্থ থাকতে পারে, থাকতে পারে হাতাশামুক্ত।
একদিকে করোনাকাল, অন্যদিকে লন্ডভন্ড অর্থনৈতিক বর্তমান থেকে উত্তরণের জন্য তারুণ্যের রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে সকল অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে থেকে। যদি দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে পারি দেশকে, দেখতে পারি অধিকার হরণের শেষকে, তাহলেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, করোনাকালের বাংলাদেশ...