মস্ত বড় জমিদার বাড়ির আদলে দোতলা বাড়ি। বাড়ির বাগানের ঠিক মাঝখানে রাখা আছে একটা সুন্দর করে সাজানো দোলনা। আর দোলনার চারিপাশ জুড়ে রয়েছে অনেক ফুল গাছ। আর প্রত্েযকটা গাছ ছোট্ট ছোট্ট রঙ বেরঙের আলো দিয়ে সাজানো। গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ পাশে রাখা, আর দোলনায় চুপ করে বসে আছে নীরা। চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে চলেছে। নীরা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশে ওঠা গোল থালার মত চাঁদের দিকে। অন্য দিন চাঁদটা সোনার মত জ¦লজ¦ল করে, কিন্তু আজ চাঁদের রূপটা কেমন ফিকে লাগছে নীরা র চোখে। চাঁদের গায়ে কালো কালো ছোপ গুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ পিছন থেকে নীরা র চোখটা কেউ চেপে ধরল।
নীরা স্পর্শ অনুভব করেই বলে উঠল, কিরে আজও এখানে আসতে ভুললিনা... রাজ?
রাজ পিছন থেকে বলে উঠল তুই কি ভাবে বুঝে যাস আমিই এসেছি। আর তো.... আজকের দিনটাই তারপর তুই তোর নতুন জগতে, আর আমি আমার এই পুরনো জগতেই পড়ে থাকব ঠিকই কিন্তু দেখাতো হবেনা এইভাবে!
নীরা শান্ত কন্ঠে বলে উঠল, তোর উপস্থিতি আমি অনুভব করতে পারি। আর আমি তো নতুন জগৎ চায়নি! তবে আমার চাওয়া পাওয়ার মূল্য নেই কারোর কাছে।
রাজ এগিয়ে গিয়ে নীরা র পাশে বসল, সাথে সাথে দোলনাটা দুলে উঠল। রাজ নীরা র কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে বলল, কিরে কাঁদছিস! খুব কষ্ট হচ্ছে....!
নীরা উদাসী চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, কি জানি হচ্ছে হয়তো! কিন্তু হলেই বা.. কি?কেউ কি আমার কষ্টের মূল্য দেবে?
রাজ নীরা র হাতটা ধরে হাসি মুখে বলে উঠল, কষ্ট পাসনা নীরা, কাকু তোর ভালোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই তুই ভালো থাকবি, সুখে থাকবি!
নীরা রাজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আর তুই ?
রাজ একই ভাবে হেসে বলে উঠল, আমার আর কি ? এমনিতেই সবাই জানে আমি বাউন্ডুলে, তাই আবার একটা কাউকে জুটিয়ে নেব।
নীরা মৃদু স্বরে বলে উঠল, কেন লুকাতে চাইছিস নিজেকে আমার থেকে? আমি তোকে খুব ভালো করে চিনি রাজ।
রাজ কথা ঘোরানোর জন্য বলে উঠল ওসব বাদদে, আজ রাত পেরলেই কাল তোর বিয়ে, আর তুই এখন এখানে বসে বসে আমার কথা ভাবছিস, তার চেয়ে বরং তোর হবু বরের সাথে কথা বল,
নীরা আবার চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, কালকের পর তোর সাথে আমার আর দেখা হবে!! কথা হবে ঠিক এখনকার মত!
রাজ বলে উঠল দেখা কেন হবেনা নিশ্চয়ই হবে, তোদের পাশের বাড়িটাইতো আমাদের। আর তোর ঘরের জানলা আর আমার ঘরের জানলা মুখোমুখি। দেখা হবে তবে কথা হবেনা আর এইভাবে!
নীরা অদ্ভুত ভাবে বলে উঠল কেন?
রাজ জোড় করে হেসে উঠে বলল, কারণ তখন তোর সাথে তোর বর থাকবে, আর আমার সাথে তোকে কথা বলতে নাও দিতে পারে। তখন আমরা না.... হয় একে অপরের কাছে অচেনা হয়ে যাব।
নীরা রাজের দিকে ঘুরে বলে উঠল, কি..... করে বলছিস, এত সহজে সবকিছু ভুলে যাওয়া কি সম্ভব!তোর আমার বন্ধুত্ব, একসাথে বড় হয়ে ওঠা, আস্তে আস্তে একে অপরকে ভালোবাসা, এত দিনের চেনা মানুষটা যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি চিনি, যে আমার মনের একান্ত আপন, কি করে সে অচেনা হতে পারে? কি... করে!কিছুতেই না.... আমি পাড়বনা! নীরা রাজের কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
রাজের চোখের কোন বেয়ে তখন জল নেমে এসেছে। রাজ নীরা র মাথায় হাত রেখে বলে উঠল, পাড়তে যে.... হবেই নীরা। সব সম্পর্কের পরিনতি সুন্দর হয়না। জানিস আমার খুব ভালো লাগতো শরৎচন্দ্রের দেবদাস, কিন্তু এখন যখন নিজের ভালোবাসার মানুষটা অন্েযর হয়ে যাবে ভাবছি, তখন খুব কষ্ট হচ্ছেরে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
নীরা বলে উঠল সত্িয, আমি কি তোর পারো, আর তুই আমার দেবদাস হয়ে যাবি!! কিন্তু এইরকম পরিনতি আমি চাইনা, চলনা রাজ আমরা পালিয়ে যাই, অনেক অনেক দূরে, সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে আমাদের জগৎ সাজাই।
রাজ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, না..... নীরা আমরা পালিয়ে গেলে বাড়ির সবার মান সম্মান সব ধূলোয় মিশে যাবে। আর তোকে কত আদর যতœ ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেছে কাকু কাকিমা তাদের অসম্মানের মুখে ফেলে দেওয়া ঠিক হবেনা। তাই আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো।
নীরা কান্নাভেজা গলায় বলে উঠল, তুই সবার কথা ভাবিস, বুঝিস, কেন যে.... তোকে কেউ বুঝলোনা!!
রাজ আলতো হেসে বলল, কেন তুই বুঝিস তো নীরা ???
নীরা শক্ত ভাবে রাজকে জড়িয়ে ধরল, রাজ নীরা কে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়ে কপালে ভালোবাসার গভীর পরশ এঁকে দিল।
নীরা রাজের বুকে মাথা রেখে কেঁদে চলেছে, আর বলে চলেছে, আমি এই বিয়ে করবনা, প্লিজ রাজ তুই কিছু কর, আমি তোর সাথেই ভালো থাকব, তোকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবনা!! কেন যে....বাপি এই কথাটা বুঝছেনা???
রাজ নীরা কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে, চোখের জলটা যতœ সহকারে মুছিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ভালো যে... তোকে থাকতেই হবে নীরা। তুই ভালো থাকলে আমি ভালো থাকব, সবাই ভালো থাকবে। আর কাকু তোর যোগ্য বর খুঁজেছে, সে তোকে খুব ভালোবাসবে, খুব ভালো রাখবে, সময়ের সাথে তুই ঠিক আমাকে ভুলে যাবি। আর আমি এখন আসি আবার কবে দেখা হবে জানিনা!! আর দেখা হলেও তোর এত কাছে আসা হবেনা, তাই আজ আমাদের সম্পর্ক এইখানেই শেষ!!!
নীরা রাজের হাত ধরে বলে উঠল, মানে তুই.... কোথায় যাবি? আর আমি তোকে কোনদিনও ভুলতে পাড়বনা।
রাজ জোড়ে হেসে বলে উঠল, আমি তো বাউন্ডুলে, আমার আবার যাওয়ার জায়গার অভাব, কোথাও একটা চলে যাব!!
নীরা কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠল, কেন..... যাবি রাজ?
রাজ নিজের দুহাত দিয়ে নীরা র মুখটা ধরে, নীরা র নাকে নাক ঠেকিয়ে বলে উঠল, নিজের চোখের সামনে তোকে অন্য কারোর হতে দেখতে পাড়বোনা নীরা !! আমি বাইরে শক্ত হলেও ভিতর থেকে যে খুব দুর্বল। আর একটা অনুরোধ, তুই বিয়ের পর যখন বাড়ি আসবি তখন প্লিজ নিজের ঘরের জানলাটা বন্ধ রাখিস। আমি অন্য কারোর সাথে তোকে দেখতে পাড়বনা। আমি আসি, ভালো থাকিস নীরা, খুব ভালো থাকিস।
রাজ আর এক মুহূর্ত না.... থেকে উঠে পড়ল, নীরা রাজের হাত ধরে ব্যাকুল ভাবে বলে উঠল, আমাকে ছেড়ে যাসনা প্লিজ....।
রাজ নীরা র হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলে উঠল, যেতে যে..... আমাকে হবেই!! আমি যে.... তোর যোগ্য হয়ে উঠতে পাড়লাম না....।
রাজ দ্রুত পায়ে চলে গেল। আর নীরা রাজের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া দেখে ধপ করে বসে পড়ল দোলনায়, কফির কাপটা উল্টে টপ টপ করে পড়তে লাগল মাটিতে। আর দোলনাটা ক্যাঁচ.... ক্যাঁচ..... শব্দ করে দুলতে লাগল আপন তালে।