ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের পর ক্ষ্যাপা ডনাল্ড ট্রাম্প কি না কি করে বসেন, সেই শঙ্কা থেকে নজিরবিহীন এক তৎপরতায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার রাশ টেনে ধরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস করে জীবন্ত কিংবদন্তি বনে যাওয়া সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং ওয়াশিংটন পোস্টের খ্যাতনামা সাংবাদিক রবার্ট কস্টা তাদের সাম্প্রতিক বইয়ে এমন দাবি করেছেন। সিএনএন জানিয়েছে, ট্রাম্প সেনা অভিযান চালানো কিংবা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে দিতে পারেন, এমন শঙ্কা থেকে নিজের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের সামরিক উপদেষ্টা ও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মার্ক মিলে। পেরিল শিরোনামের ওই বইয়ে উডওয়ার্ড ও কস্টা লিখেছেন, ভোটে হেরে যাওয়ার পর ট্রাম্প উন্মাদ হয়ে পড়েন বলেই মনে করছিলেন মিলে। ২০২০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পরও কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এরই একপর্যায়ে ট্রাম্প সমর্থকরা ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত ওই হামলায় ট্রাম্পের উসকানি ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই হামলার দুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রধান জেনারেল মার্ক মিলে গোপনে পদক্ষেপ নেন প্রেসিডেন্টের উপর ছড়ি ঘোরানোর, এমনটাই বলছেন উডওয়ার্ড ও কস্টা। তারা লিখেছেন, ক্যাপিটল ভবনে হামলায় জেনারেল মিলে বড় ঝাঁকুনি খেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে ভোটে হার মানতে না পেরে ট্রাম্পের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে রয়েছেন, অনেকটা উন্মাদের মতো হয়ে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মার্ক মিলে।যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল মার্ক মিলে। মিলের উদ্বেগ ছিল, ক্ষ্যাপাটে ট্রাম্প এখন যে কোনো কিছু করে বসতে পারেন। তা ঠেকাতে তিনি ৮ জানুয়ারি পেন্টাগনে তার অফিসে গোপন এক বৈঠকে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের ডাকেন বলে ‘পেরিল’ বইয়ে লেখা হয়েছে। লেখকদ্বয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ‘ওয়ার রুম’ এর ওই বৈঠকে জেনারেল মিলে সহকর্মীদের বলেন, সেনা অভিযান কিংবা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে তাকে না জানিয়ে যেন কিছু করা না হয়, এমনকি প্রেসিডেন্টের নির্দেশ এলেও। “আপনারদের কে কী বলল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আপনাদের নিয়মের মধ্যে থেকে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চলতে হবে। আর আমি এই প্রক্রিয়ার একটি অংশ।” বইয়ে লেখা হয়েছে, কড়া এই নির্দেশনা দেওয়ার পর ওই কক্ষে ঘুরে ঘুরে সবার সামনে যাচ্ছিলেন জেনারেল মিলে, আলাদাভাবে প্রত্যেকের চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, “আমি কী বলেছি, বুঝতে পেরেছেন?” হোয়াইট হাউজের কাছে সমবেত কয়েক হাজার সমর্থকের উদ্দেশে ট্রাম্প বক্তব্য দেওয়ার পর এই হামলা হয়েছিল ক্যাপিটল ভবনে। ছবি: রয়টার্সহোয়াইট হাউজের কাছে সমবেত কয়েক হাজার সমর্থকের উদ্দেশে ট্রাম্প বক্তব্য দেওয়ার পর এই হামলা হয়েছিল ক্যাপিটল ভবনে। দুই শতাধিক সাক্ষাৎকার, প্রত্যক্ষদর্শী, আর ঘটনায় জড়িত থাকা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ট্রাম্পের ক্ষমতায় থাকার শেষ দিনগুলো নিয়ে ‘পেরিল’ লিখেছেন উডওয়ার্ড ও কস্টা। শুধু তাই নয়, তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হতে নানা দলিল, ডায়েরি, ইমেইল, ফোনালাপের প্রতিলিপি, সভার কার্যপত্রও খতিয়ে দেখেছেন তারা। বইটি আগামী ২১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবে, তবে তার আগেই এর একটি কপি পেয়েছে সিএনএন। বইটিতে লেখা হয়েছে, ক্যাপিটল হিলে হামলার পরই ট্রাম্পের হাতে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন জেনারেল মেলে। তার এমন শঙ্কাও ছিল যে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া ঠেকাতে ট্রাম্প কারও সঙ্গে যুদ্ধও বাঁধিয়ে দিতে পারেন। তখন তিনি চীনের উদ্বিগ্ন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার কাছ থেকে ফোন পান তিনি, ফোন আসে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির কাছ থেকেও। মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। ছবি: রয়টার্সমার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। পেলোসির সঙ্গে মিলের ফোনালাপের একটি প্রতিলিপি পেয়েছেন সাংবাদিক উডওয়ার্ড ও কস্টা। আর সেই ফোনালাপে সেনাপ্রধান বারবার স্পিকারকে আশ্বস্ত করছিলেন যে পরমাণু অস্ত্র নিরাপদেই রয়েছে। পেলোসি বলছিলেন, ক্যাপিটলে যে হামলা করাতে পারে, সে যে আরও কত কী করতে পারে, তার কি কোনো ঠিক আছে? “আপনি তো জানেন যে সে (ট্রাম্প) পাগল হয়ে গেছে,” এমনটাও বলছিলেন পেলোসি। আর ট্রাম্পকে নিয়ে এসব কথায় পেলোসির সঙ্গে মিলে একমত পোষণ করেছিলেন বলে জানান উডওয়ার্ড ও কস্টা। হাত মেলাননি ট্রাম্প, তার পেছনেই ভাষণের কপি ছিঁড়লেন পেলোসি তারা লিখেছেন, এরপর জেনারেল মিলে গোয়েন্দাদের ডেকে সব দিকে কড়া নজর রাখতে বলেছিলেন। উডওয়ার্ড ও কস্টা বলছেন, অনেকে এই তর্ক তুলতে পারেন যে জেনারেল মিলে যা করেছেন, তা তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে করেছেন, নিজের হাতে অনেক ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তবে মিলে বিশ্বাস করেন, তিনি যা করেছেন সৎ উদ্দেশ্যেই করেছেন। তিনি এটা এজন্যই করেছেন যেন বিশ্ব ব্যবস্থা যেন কোনো ঐতিহাসিক ঝঞ্ঝাটে না পড়ে, চীনের সঙ্গে যেন দুর্ঘটনাবশত কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া না হয়, আর পরমাণু অস্ত্র যেন ব্যবহার না হয়।