বিশ্ব মিডিয়ায় এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রসংগ আফগানিস্তানে তালেবানের ঝড়ো বিজয় এবং গ্লানিময় পরাজয় বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের। বিস্ময়ে হতবাক সবাই। দখলদার আমেরিকান নেতৃত্বাধীন ন্যাটো (ঘঅঞঙ) বাহিনীর কাছেও এটি অকল্পনীয় ছিল। খোদ তালেবানও বুঝতে পারেনি এত সহজে বিনা রক্তপাতে এত দ্রুত ন্যাটো বাহিনীর দখলে থাকা রাজধানী কাবুল তাদের দখলে আসবে। মাত্র তিন মাসে একের পর এক শহর ও প্রদেশ দখল করে তারা এত দ্রুত কাবুলে পৌঁছাতে পারবে এটি কেউই আশা করেনি। এমনকি নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেই আমেরিকান বাহিনী কাবুল ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে স্থানীয় সময় রাত বারোটা বাজার এক মিনিট আগে। তাদের আরো শতাধিক এবং যুক্তরাজ্য ও জার্মানীর দুই-তিন শতাধিক সেনা শেষ বিমানটি ধরতে পারেনি। এরই মধ্যে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি দেশ থেকে পালিয়ে যান। ফেব্রুয়ারী ২০২০ সালে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত আমেরিকান-তালেবান বৈঠকে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার ধারাবাহিকতায় ৩১ আগস্ট ২০২১ তারিখের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কাবুল তথা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে বলে সিন্ধান্ত হয় এবং তাদের বাহিনী ও আফগান দোসররা বিদায় নেয়া পর্যন্ত কাবুল বিমান বন্দর তাদের অধীনে থাকবে। তালেবানরা তা পালন করেছিল। এই বিদায়ের মাধ্যমে ২০ বছরের ব্যর্থ সামরিক অভিযানের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে। এই নীরব বিদায়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগন আহত হয়েছে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের ভাষায়, “আফগানিস্তানে আমেরিকার নাগ কাটা গেছে”। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এজন্য বিপুলভাবে সমালোচিত হয়েছেন। এই অভিযানে মার্কিন বাহিনীর প্রায় তিন হাজার সেনা নিহত এবং আরো ২০ হাজারের বেশী আহত হয়। অনুরূপ ভাবে বৃটিশ বাহিনীর ৫০০ এবং অন্যান্য ন্যাটো সদস্যের কয়েক হাজার নিহত ও আহত হয় তালেবানদের হাতে। আর তালেবান বাহিনীর প্রায় ৮৫ হাজার নিহত এবং ৭০ হাজার আহত হয়। বিপুল সাধারণ মানুষ নিহত ও আহত হয়। অনেক বাড়ী Ñ স্থাপনা ধ্বংস হয়। এছাড়া, কয়েক লক্ষ বেসামরিক আফগান নিহত এবং প্রায় ৮০ হাজার পুলিশ ও সরকারী সেনাসদস্য নিহত হয়।
বিশ বছরে তালেবানদেরতো ধ্বংস করতে পারেইনি বরঞ্চ তালেবান বাহিনী নিয়ত মার্কিন বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং তাদের কয়েক গুন শক্তি বৃদ্ধি হয়। শহরের বাইরে তালেবানরাই নিয়ন্ত্রণ করত। এই বিশ বছরে মার্কিন লালিত তিন লাখ আফগান সেনাবাহিনী পুষতে এবং অন্যান্য খাতে তাদের খরচ হয় প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু এক লাখেরও কম তালেবান বাহিনীর কাছে সরকারি বাহিনী ছিল নস্যি মাত্র। তালেবানের জয়ে তাসের ঘরের মত উড়ে গেল সেই বাহিনী। তারা ভাড়াটে বাহিনীর মত পালিয়ে বাঁচল। পাঞ্জশির বা পানশির প্রদেশ ব্যতীত পুরো আফগানিস্তান ১৫ আগস্ট ২০২১ -এর মধ্যে তালেবানের দখলে আসে। শেষ পর্যন্ত তুমুল সংঘর্ষের পর তাও দখলে চলে আসে। পাহাড় ও উপত্যকাময় ও তাজিক প্রধান পাঞ্জশিরের প্রাণপুরুষ আহমেদ শাহ মাসুদ ও তাঁর পুত্র আহমেদ মাসুদের দখলেই বরাবর ছিল। এরপরই তালেবান সরকার গঠন করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় (০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১)। আফগানিস্তানে এটি তালেবানের দ্বিতীয় সরকার। তারা প্রথম সরকার গঠন করে ১৯৯৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার বিদায়ের পর যা পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান অভিযানে আসে ২০০১ সালে “নাইন ইলেভেন” বা “৯/১১” নামে এবং টুইন টাওয়ার নামে খ্যাত নিউইয়র্কের ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টারে বিভৎস সন্ত্রাসী হামলার পর। আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন এই হামলা পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেছে এই অভিযোগ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তরের দাবী করে আফগানিস্তানের নিকট। কিন্তু তৎকালীন তালেবান সরকার প্রমান ব্যতীত তা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়। এর পরই শুরু হয় আফগান অভিযান। জড়িয়ে পড়ে স্থল যুদ্ধে। তালেবান সরকারের পতন হয়, কিন্তু তালেবানের পতন হয়নি। দশবছর পর ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়ীতে আমেরিকান বাহিনী লাদেনকে হত্যা করে। সে এক ভিন্ন ইতিহাস। কিন্তু এরপর আরো দশ বছর যুদ্ধে আটকা পড়ে মার্কিন বাহিনী। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তান উভয়ে। তালেবান অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে এবং যুক্তরাষ্ট্র ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায় পৌছে। ২০১৩ সাল থেকেই তালেবানের সাথে তাদের যোগাযোগ শুরু হয়। কিন্তু অগ্রগতি হয়নি। অবশেষে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে বিদায়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ৩০শে আগস্ট ২০২১ বাস্তবায়িত হয়। তালেবান পরমুহূর্তেই রাতভর বর্নিল বিজয় উৎসব করে। জনগনের বিজয় হয়। আফগানরা কখনো বিদেশী শক্তিকে মেনে নেয়নি। কয়েকবারে ৪০ বছরের বৃটিশ শাসন শেষে ১৯১৯ সালে স্বাধীন হয় সোভিয়েত রাশিয়ার ১০ বছরের দখল এবং শেষে মার্কিন ও মিত্রবাহিনীর অভিযান কোনটার কাছেই আফগানরা নতি স্বীকার করেনি।
তালেবানদের বিজয়ে জনগণ শংকিত ও আতংকিত বলে মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের অধিকার, সংগীত , খেলাধুলা এসব নিয়ে তালেবানদের দৃষ্টিভংগির ব্যপারে সোচ্চার বিভিন্ন দেশ, মিডিয়া এবং আধুনিক গনতন্ত্রপন্থীরা। ১৯৯৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসে তালেবানরা কট্টর মৌলবাদী আচরণ করে। বিশেষ করে নারীদের আধুনিক শিক্ষা ও স্বাধীন পেশা গ্রহণে তালেবান বাধ সাধে, বারাবাড়ি করে। তারা শরিয়াহ আইনের আওতায় আধুনিকতা বা পশ্চিমা সংষ্কৃতিকে বর্জন করে। সেই আশংকার কথা এখন বিপুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে। তাই এবারে তারা পরিবর্তিত সংষ্করণ বলে দাবী করছে, এমনটি প্রচারিত হচ্ছে। তারা যে রাজনীতি, কুটনীতি এবং সমরনীতি সবদিকেই বুৎপত্তি লাভ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। যদি তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে উদারনীতি গ্রহণ করে তাহলে সেই আশংকা দূর হবে। অবশ্য সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে তালেবান ঘোষণা দিয়েছে যে তারা আধুনিক গনতন্ত্র অনুসরণ করবে না, শরিয়াহ আইনে দেশ শাসন করবে। অনুমান করা হচ্ছে ইরানের ধাঁচে সরকার পরিচালনা করবে। মহিলাদের শরীয়াহ আইন মেনে উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত কার্যক্রম চালাবে। সরকারের ধরণ দেখেও তাই বোঝা যাচ্ছে। নূতন সরকারে কট্টরপন্থীদেরই প্রধান্য রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখন্দ সরকার প্রধান থাকলেও ইরানের আয়াতুল্লাহ খামেনীর মত সুপ্রীম কমান্ডার হিসাবে রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় শাখার প্রধান থাকছেন হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা, মন্ত্রীসভায় কোন নারী স্থান পাননি।
অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণার আগে তালেবান বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন ও বাহিনী নেতা এবং অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করেছিল একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক সরকার গঠনের, কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। পানশির দখলকারী আহমেদ মাসুদ বাহিনীর সাথেও জোর আলোচনা করা হয়েছিল যাতে তারা আত্মসমর্পণ করে এবং সরকারে অংশ গ্রহণ করে। তাও ভেস্তে য়ায়। অবশেষে তুমুল যুদ্ধে তা নির্ধারিত হয়। অবশ্য এতে অনেক তালেবান সেনা নিহত ও আহত হয়। বর্তমান সরকারে পশতুনদেরই প্রধান্য বজায় রয়েছে। তালেবান মূলত: পশতুনদেরই প্রতিনিধি যারা সমগ্র জনগণের ৪২%। তারপর রয়েছে তাজিক (২৩%), হাজারা (১০%) এবং উজবেক (৯%)। এর প্রত্যেকটিরই রয়েছে গোত্র-উপগোত্র যেমন রয়েছে সোমালিয়ায় যার ফলে কোন দলই সোমালিয়ায় স্থায়ী সরকার গড়তে পারেনি। সেখান থেকেও মার্কিন বাহিনী বিদায় নিয়েছে তবে ফেলে গিয়েছে অস্থিতিশীল সরকার। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও এমন আশংকা রয়েছে। এক সময়ের তালেবান বাহিনীর সহযোগী হিসেবে যেসব সংগঠন মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তাদের অনেকেই বেঁকে বসেছে এবং এই সব দল-উপদল ও গোত্র-উপগোত্রকে এক টেবিলে বসানো তালেবানের পক্ষে কতটুকু সম্ভব তা দেখার বিষয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী সন্ত্রাসী ভূমিকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘মোস্ট ওয়ানেড’ বা কালো তালিকাভুক্ত রয়েছে। এরপরে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কিরূপ আচরণ করে তাও দেখার বিষয়।
তালেবানের পক্ষে সমগ্র আফগানিস্তান সুসংগঠিত করা দৃরূহ কাজ। এত বেশি কট্রর জাতি-উপজাতি ও গোত্রে বিভক্ত আফগানিস্তানের জনগনকে কোন এক শাসন ব্যবস্থাধীনে আনা প্রায় অসম্ভব। ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীনও তা সম্ভব হয়নি। আমেরিকানরাও সব গোষ্ঠীকে পোষ মানাতে পারেনি যদিও দু’একটি সংগঠন তাদের সহযোগিতা করেছিল। পশতুন প্রধান তালেবানকে অন্যরা সমর্থন করলেও বা সরকারে অংশগ্রহণ করলেও নিজস্ব মূল্যবোধ ও কৃষ্টি অনুযায়ী অনেকক্ষেত্রে অটল থাকবে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে অধিকাংশ জনগনের সমর্থন না থাকলে তালেবানদের পক্ষে বিজয় সম্ভব হত না। তারপরও কটর গোত্র - গোষ্ঠী তালেবানদের সংকটে ব্যস্ত রাখবে। এর উপরতো রয়েছে আন্তর্জাতিক ও ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড়রা। পশ্চিমা শক্তিগুলো কখনো ইসলামী শাসন মেনে নেবে না। পশ্চিমা মিডিয়া তালেবানদের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরছে এবং প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে ও চালাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত সহজে এই পরাজয় ভুলে যাবেনা। কাবুল ত্যাগ করার পরও তারা মধ্যপ্রচ্যের ঘাঁটি থেকে ড্রোন হামলা চালিয়ে নারী-শিশুসহ প্রায় দুইশত মানুষ হত্যা করে। তারা দাবী করেছে বিদায়ের প্রাঙ্কালে ২৭ শে আগষ্ট আফগান শাখা আইএসকেপির (ওংষধসরপ ঝঃধঃব কযড়ৎধংধহ চৎড়ারপব) আত্মঘাতি বোমা হামলার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তা করেছে এবং দাবী করেছে আইএস-এর দুই শীর্ষ নেতাকে হত্যা করেছে। তাই পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে তারা যে সক্রিয় থাকবে তা অনুমেয়। ওদিকে কাবুলের হামিদ করজহাই বিমান বন্দরে বিদায়ের আগে মার্কিন ও মিত্রদের সেনা ও নাগরিক এবং আফগান সেনা ও দোসরদের প্রায় দেড় লাখ লোককে বিমানে সরিয়ে নেয়। এদের মধ্যে অনেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ও জ্ঞানী-বিজ্ঞানী ছিলেন। ফলে আফগানিস্তান অনেকটা মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। সরকার পরিচালনায় মেধাসম্পন্ন লোকবল যে প্রয়োজন তাতো অনস্বীকার্য। ওদিকে এখনো কোন দল তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই বিভিন্ন দল যেমন তালেবানের কর্মকান্ড দেখে ধীরগতিতে অগ্রসর হবে তেমনিভাবে তালেবানও সময় নিয়ে সরকার গঠন ও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তালেবান ইতিমধ্যে সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেছে। হয়তো কয়েকবছর লেগে যাবে ক্ষমতা সুসংহত করতে।
বিশ^ব্যপী বলা হচ্ছে যে ২০ বছরের যুদ্ধে যুক্তরাষ্টের পরাজয় হয়েছে। আসলে কি তাই? মার্কিন সিনেটে এবং মিডিয়ায় জো বাইডেনকে এজন্য দায়ী করা হয়। যে ডোনান্ড ট্রাম্প তাদের আফগানিস্তান ত্যাগের চুক্তি করেছিল তালেবানের সাথে গত বছর, তিনিও বাইডেনের কড়া সমালোচনা করেছেন। তাদের কথা হল, এত তড়িঘড়ি করে কেন আমিরিকান ও মিত্র সেনারা আফগান ত্যাগ করল, আরো সময় নিয়ে করলে ভাল হত। কেননা তালেবান যখন কাবুল বিমান বন্দর অবরোধ করল তখন বিমান বন্দরে হৈ হুল্লোড় ও বিশৃংখলা লেগে গেল। তালেবান আতংকে আফগানরা দেশ ত্যাগ করার জন্য বিমান বন্দরে প্রচন্ড ভীড় করছিল। মিত্র সেনাদের সাথে আফগানিস্তানের মার্কিন দোরসদের এবং সরকারী সেনাদেরও অপসরণ করা হয়েছিল। একটা বিশৃংখলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হল। তাই মধ্যে আত্মঘাতি জোড়া বোমা হামলা। শেষ পর্যন্ত কিছু মার্কিন ও ন্যাটো সেনাও বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে বিমান বন্দরে পৌছাঁতে পারেনি। তারা ৩০ শে আগষ্টের পর আফগানিস্তানেই রয়ে যায়। তাই আসা করা হয়েছিল আরো কিছুদিন সময় নিলে সবাইকে আফগানিস্তান ত্যাগ করার সুযোগ হত। কিন্তু বাইডেন তা করেননি, এর যথেষ্ট যুক্তি ছিল। যে নাজুক পরিস্থিতিতে তারা বিদায় নিয়েছে তা আরো খারাপ হতে পারতো। যেখানে সারা আফগানিস্তান তালেবানের দখলে চলে গেছে, কাবুল বিমানবন্দর অবরুদ্ধ ছিল এবং বোমা হামলা হয়েছিল সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারতো, আরো বোমা হামলা এবং গোলা বিনিময় হতে পারতো। শুধু চুক্তির কারনে তালেবান বিমানবন্দরে ঢুকেনি যাতে মার্কিন বাহিনী ও সংগী - সাথীরা নিরাপদে অপসারিত হতে পারে। ওদিকে চুক্তির মেয়াদও শেষ, এর পর থাকলে কি হত তা অনুমান করা সহজ ছিল না। তাই বাইডেন মানে মানে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে মার্কিন পরাজয় দৃষ্ট হলেও তা সাময়িক। ২০ বছরে তাদের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, সামরিক - বেসামরিক লোক ক্ষয় হয়েছে। কিন্তু তারা এই দীর্ঘ সময়ে আফগানিস্তান অর্থাৎ একটি মুসলিম রাষ্টকে পদানত করেছে এবং বেসামাল আবস্থায় রেখে গিয়েছে। আফগান তরুণদের পশ্চিমা সংষ্কৃতিতে রূপান্তরিত করেছে। মেয়েদের ঘরের বাইরে এনেছে, নিজস¦ দালাল সৃষ্টি করেছে যা তালেবানকে সামলাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ইতিমধ্যে তালেবান বিরোধীরা এবং নব্য তরুণ-তরুণীরা আন্দোলন-মিছিল করছে। এসব মার্কিন দখলদারিত্বের ফল। সর্বোপরি তালেবান সরকার আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিদায়ের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা চলমান আর্থিক সাহায্য বন্ধ রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থও আটকে দিয়েছে। এমনিতেই আফগানিস্তান একটি দরিদ্র দেশ। তার উপর যুদ্ধের বিধ্বস্ততা। এটি তালেবানদের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আফগানিস্তানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
আরেকটি বিষয় হল, মার্কিনীরা যুদ্ধ করে অন্য দেশে, নিজেদের দেশে করে না। তাই তাদের আক্রমণে প্রতিপক্ষের যা মৃত্যু হয় তার বেশী হয় সাধারণ জনগণের। সাধারণতঃ তারা নিজেরা যুদ্ধ করেনা, দোসর বাহিনী তৈরী করে তাদের দিয়েই তাদের দেশ ধ্বংশ করে। সোমালিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং অন্যান্য দেশে তারা তাই করেছে। অতএব তাদের ক্ষতিতো সীমিত। আর এই যে দোসর বাহিনীর মাধ্যমে বিষবৃক্ষ তৈরী করে গেল তারা নিয়ত দেশ বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকবে। পৃথিবীর তাবৎ সা¤্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী তাই করে যেমন করেছিল বৃটিশ ও রাশিয়ানরা। তারা দেশটাকে নিজস্ব দৃষ্টি-মূল্যবোধ ভুলিয়ে তাদের কৃষ্টি তৈরি করে দিয়ে যায়। এই উপমহাদেশে তাই হয়েছে। এখনো আমরা সেই ধারায় মজে আছি। তিন লক্ষ আফগান বাহিনী কোথায় ? তারা অনেকে অপসারিত হয়েছে, অনেকে পালিয়েছে, অনেকে বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এরাওতো আফগান। লক্ষ লক্ষ আফগান উদ্ধাস্তু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশকে অনুরোধ করছে উদ্বাস্থ গ্রহণে। এরাওতো মার্কিন অনুগত। তাদের নিজের দেশেও যারা গিয়েছে তাদেরকেও অন্য দেশে পাঠানোর চেষ্টা করছে। উগান্ডাকে রাজী করেছে ২০,০০০ উদ্বাস্তু গ্রহণে। তারা যে মিশন নিয়ে আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়েছে, তা ঠিকই অর্জিত হয়েছে। তারা তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, অনুগত সেনাবাহিনী তৈরী করেছে, আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে পশ্চিমা কৃষ্টি চালু করেছে, ইসলামী মূল্যবোধকে ব্যহত করেছে, আল-কায়েদাকে সাইজ করেছে, মোল্লা ওমর ও ওসামা বিন লাদেনকে খতম করেছে, আরো কত কি। জর্জ ডব্লিউ বুশ (জুনিয়র) আফগান অভিযান শুরু করেছে, বারাক ওবামা লাদেনকে হত্যা করেছে, ডোনাল্ট ট্রাম্প তালেবানের সাথে শান্তি চুক্তি করেছে, আর জো বাইডেন তা কার্যকর করেছে। এতো তাদের পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা, কে জানে এক সময়কার তাদের সৃষ্ট ও মদদপুষ্ট তালেবান আজ শত্রু হলেও কাল মিত্র হবে না। আফগানিস্তানের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং শক্তিমানদের প্রতিযোগিতার ফলাফল ভবিষ্যতই বলবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক