গ্রীক পুরাণের ঊষাদেবী অরোরা রক্তমাংসের মানুষ টিথোনাসের প্রেমে পড়েছিল একবার। টিথোনাসকে অমরত্ব দানের জন্য তাই সে অলিম্পাস অধিপতি জিউসের শরণাপন্ন হয়। অরোরা’র অনুরোধে জিউস টিথোনাসকে অমরত্ব প্রদান করে ঠিকই, কিন্তু অমর যৌবন প্রদান করে না। অরোরা’ও জিউসকে সে কথা বলতে ভুলে যায়। টিথোনাস ধীরে ধীরে একসময় বার্ধক্যে উপনীত হয়। তার প্রেয়সী অরোরা সুন্দরি ও যৌবনবতী, অথচ সে বার্ধক্য কবলিত। জীবন তার কাছে দুঃসহ হয়ে উঠে। মৃত্যুর পেয়ালা পান করার জন্য সে অস্থির হয়ে উঠে। প্রত্যেক প্রত্যূষে অরোরা যখন তার রথ নিয়ে বের হয় টিথোনাস তখন তার কাছে মৃত্যু ভিক্ষা চায়। কিন্তু অরোরা’র তার জন্য চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কেননা দেব-দেবীরা একবার কোন বর প্রদান করলে তা আর ফিরিয়ে নিতে পারে না।
আসলে মৃত্যু আছে জন্যই জীবন এত সুন্দর। আমরা যদি অফুরন্ত জীবন পেতাম তাহলে জীবনের প্রতি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতাম। কাজকর্ম, সংসার-ধর্ম, খেলাধুলা, হাসি-আড্ডা-গানÑকোনকিছুই মধুর লাগতো না। প্রকৃতির সৌন্দর্য সুষমাও ফ্যাকাসে মনে হতো। জীবন সংকীর্ন বলেই জীবনকে উপভোগ করার একটা তাড়না থাকে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই সংকীর্ন জীবনটাই কারও কারও কাছে দীর্ঘ হয়ে উঠে, হয়ে উঠে বোঝা। মূল্যবান জীবনটাকে তারা সহজেই অপচয় করে ফেলে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়ার মাধ্যমে। তারা এই বিষয়টা ভাবে না যে তাদের জীবনটা শুধু তাদের একার নয়। তাদেরকে ঘিরে আরও অসংখ্য মানুষের জীবন আবর্তিত হয়। তারা এটাও ভাবে না যে জীবন হলো সৃষ্টিকর্তার দেয়া আমানত। কেউ ইচ্ছে করলেই তা বিনষ্ট করতে পারে না।
তবে এ কথাও সত্য যে মানুষ এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে সহজে চলে যেতে চায় না। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ এই সুন্দর ভুবন মানুষকে মায়ার জালে আটকে ফেলে। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ কেনো এত তাড়াহুড়া করে এই সুন্দর ভুবন থেকে চলে যায় স্বেচ্ছায়? কি তাদের চলে যেতে বাধ্য করে? কেন এই আত্মহত্যার প্রবণতা?
আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো মানসিক চাপ। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মানসিক চাপ থাকে। চাপটা বেশি হয়ে গেলে কারো কারো মনে হয়, তিনি আর সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যার পথটাই তার কাছে সহজ মনে হয়। এ ছাড়া যৌতুক, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, হতাশা, অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অবসাদ ও হেনস্থার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিষণ্ণতায় যারা ভোগেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে বেশি। কারণ জীবন নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচ- নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। ছেলেবেলা থেকে যারা নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন করে, এবং যে সমস্ত তরুণ-তরুণী শৈশবকালে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করে।
ইতালির কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস অবশ্য এ ক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ‘আত্মহত্যা করার জন্য কারো কারণের অভাব হয় না।’
মার্কিন লেখক অ্যাডওয়ার্ড ডালবার্গ বলেন, ‘যখন কেউ উপলব্ধি করে, তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। তখন সে আত্মহত্যা করে নতুবা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো মানুষের জীবনই মূল্যহীন বা অর্থহীন হতে পারে না। তথাপি কেউ যদি তা মনে করেন, আমি চাইব, আত্মহত্যার পরিবর্তে তিনি ভ্রমণকেই বেছে নেবেন।’
বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তাঁর ‘নৈতিক অধিবিদ্যার মূলনীতি’ বইয়ে আত্মহত্যার বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। ওই বইয়ে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন-- ‘যে আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে সে যেন নিজেকে জিজ্ঞেস করে তার এই হারিয়ে যাওয়া মানবজাতির উদ্দেশ্যের সাথে কতোটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?’
কান্টের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা একটি অনৈতিক কাজ। তাঁর মতে, ‘যে আত্মহত্যা করলো, সে নিজেকে ব্যবহার করে নিজের ইচ্ছে পূরণ করলো। কিন্তু একজন মানুষ ব্যবহৃত হতে পারে না।‘
দার্শনিক হোবস তাঁর ‘লেভিথান’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, ‘নিজের জীবন ধ্বংসকারী যেকোনো ক্রিয়াই প্রকৃতিকভাবে নিষিদ্ধ। এই প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করা অযৌক্তিক এবং অনৈতিক। মানুষের জন্য যৌক্তিক হলো সে মৃত্যুকে ভয় পাবে এবং সে সুখের প্রত্যাশায় থাকবে।‘
তবে কিছুকিছু দার্শনিক অবশ্য আত্মহত্যার স্বপক্ষেও কথা বলেছেন। আত্মহত্যা সমর্থনকারী এসব দার্শনিক ও তাঁদের দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও অনেক তরুণ তরুণী আত্মহত্যার মতো দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিতে উৎসাহী হয়ে উঠে। আত্মহত্যা করা প্রথম দিকের গ্রীক ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন এম্পেদোক্লেস। তিনি খ্রিস্টের জন্মের ৪৩৪ বছর আগে আত্মহত্যা করেন। তাঁর একটি বিশ্বাস ছিল মৃত্যু একটি রূপান্তর। এই ধারণাটি তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিল। নিজেকে সিসিলীয় এটনা পর্বতের আগ্নেয়গিরিতে ফেলে এম্পেদোক্লেস আত্মহত্যা করেছিলেন।
ফরাসী-আলজেরীয় উদ্ভটত্ববাদী দার্শনিক আলবেয়ার কামু ‘ঈশ্বরহীন মহাবিশ্বে আত্মহত্যা একটি প্রয়োজনীয় কাজ’---এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করাকেই উদ্ভটত্ববাদের লক্ষ্য হিসেবে দেখেছেন। কামুর কাছে আত্মহত্যা করার মানে হলো স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করা। তার মতে, বাস্তবতার উদ্ভটত্ব অনুধাবণের পর তার থেকে কুহকে বা ধর্মে বা মৃত্যুতে পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র সমাধান নয়। জীবনের উদ্ভট অর্থহীনতা বোঝার পর পালিয়ে না গিয়ে তা থেকে উদ্দীপনা নিয়ে জীবন আলিঙ্গণ করতে হবে। তাঁর বিখ্যাত ‘দি আউটসাইডার’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মিউরসালুট, যাকে মৃত্যুদ-াদেশ দেওয়া হয়েছিল, তাকে তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবেইÑ‘উদ্ভট লোকটি আত্মহত্যা করবে না, সে বাঁচতে চায়, তার কোন ধরনের নিশ্চয়তা বর্জন না করে, কোন ভবিষ্যৎ ছাড়া, কোন আশা ছাড়া, কোন কুহক ছাড়া ... এবং কোন কিছু থেকে ইস্তফা দেয়া ছাড়াই। সে মৃত্যুকে দেখছে অণুরাগপূর্ণ মনযোগের সাথে এবং সেই অণুরাগপ্রসূত মুগ্ধতা তাকে মুক্তি দিচ্ছে। সে, দন্ডাদেশপ্রাপ্ত লোকটি, একধরনের স্বর্গীয় দায়িত্বহীনতা অনুভব করছে।‘
কামুর উদ্ভট তত্ত্বে কথার ঝলক আছে ঠিকই, কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। মানবজীবন উদ্ভট নয় এবং তা অর্থহীনও নয়। কাজেই তাঁর এই তত্ত্বে প্রলুব্ধ হয়ে আত্মহত্যাকে সহজভাবে নেয়া বোকামি। সুন্দর এই পৃথিবীতে কারও আত্মহত্যা কোনভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু আমরা যতোই কামনা করি না কেন আত্মহত্যা কিন্তু থেমে নেই। আমাদের দেশে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান দেখলে তো রীতিমত স্তম্ভিত হতে হয়। প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে সব বয়সের মানুষ থাকলেও ২১ থেকে ৩০ বছরের নারীর সংখ্যাই বেশি। বছর হিসেবে এই সংখ্যা কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার। গত এক যুগে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭.৮ থেকে ৩৯.৬ জন। করোনা মহামারি চলাকালে এক বছরে সারাদেশে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যাকে প্রতিরোধ করতে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার অবশ্য অন্ত নেই। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ছাড়াও বিভিন্ন বৈশ্বিক সংগঠন নানা প্রচার-প্রচারণা, ও কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আত্মহত্যার নেতিবাচকতা তুলে ধরার প্রয়াস চালায় প্রায়। ২০০৩ সাল থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসটি পালন করতে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একসাথে কাজ করে। ২০১১ সালে অনুমনিক ৪০টি দেশ এই দিবসটি উদযাপন করে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের নিম্ন আয়ের কোন দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে কোন কৌশল বা কর্মপন্থা ঠিক করা নেই যেখানে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশসমূহের ১০% এবং উচ্চ আয়ের সব দেশেই এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে।
২০০৩ সালে সর্বপ্রথম পালিত হওয়া দিবসে, ১৯৯৯ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বিষয়ে নেওয়া কিছু পদক্ষেপেরও আলোকপাত করা হয় যেখানে প্রধান কৌশল নির্ধারণ করা হয়ঃ
১) আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ এবং এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য বৈশ্বিক একটি সংস্থার সাথে সাথে আঞ্চলিক ও জাতীয পর্যায়ে বিভিন্ন খাতে এ ব্যাপারটি গুরুত্ব দেওয়া।
২) বিভিন্ন দেশের আত্মহত্যা প্রতিরোধের নীতিমালাসমূহ ও পরিকল্পনাসমূহের বিকাশ ঘটানো এবং তাদের দক্ষতাকে শক্তিশালীকরণ।
এ বছরেও দিবসটি পালিত হলো দু’দিন আগে। এবারে দিবসটির শ্লোগান ছিল ‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করো’।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই আত্মহত্যা করার আগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের ইচ্ছের কথা অন্যের কাছে, বিশেষকরে বন্ধু-বান্ধবের কাছে কম-বেশি প্রকাশ করে থাকে। তাদেরকে ইশারা-ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। তাদের দেয়া সেসব তথ্য, ইশারা-ইঙ্গিতকে গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আগামীর পৃথিবী হোক আত্মহত্যামুক্ত পৃথিবী। জীবন থেকে পালিয়ে না গিয়ে আমরা জীবনকে উপভোগ করতে শিখি। নিজে সচেতন হই, অপরকেও সচেতন হতে সাহায্য করি। মন আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকলে প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেই। একাকিত্ব ভালো না লাগলে ভ্রমণে বের হয়ে পড়ি। কে জানে, হয়তো ঘুরতে ঘুরতেই খুঁজে পাওয়া যাবে জীবনের সৌন্দর্য।
তাহসিনুল ইসলাম : কথাশিল্পী