পিআরএল, পেনশন ও আনুতোষিক, জিপিএফ মঞ্জুরী, উচ্চতর স্কেল মঞ্জুরী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর যে কোন ফাইল ফরওয়ার্ডিং করাতে ঘুষ দিতে হয় উপপরিচালক পরিবার পরিকল্পনা ফরিদপুরের কার্যালয়ে। ক্ষেত্রভেদে ঘুষের রেটও ভিন্ন। এজন্য ঘুষের একটি তালিকাই তৈরি করা হয়েছে। ধার্য্যকৃত ওই ঘুষ না দিলে দীর্ঘদিনেও কাজ হয়না। এই লাগামহীন দুর্নীতির সাথে জড়িত উপপরিচালকের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ করেছেন তারই অধস্তন প্রায় শতাধিক কর্মচারী।
তাদের অভিযোগ, উপপরিচালক পরিবার পরিকল্পনা ফরিদপুর মাহবুবুল ইসলামের স্বাক্ষরে কোন ফাইল ফরোয়ার্ডিংয়ের জন্য পিআরএল (তৃতীয় শ্রেণি) ৩ হাজার টাকা, পেনশন ও আনুতোষিক (তৃতীয় শ্রেণি) ৫ হাজার টাকা, পিআরএল, পেনশন ও আনুতোষিক (চতুর্থ শ্রেণি) ৩ হাজার টাকা, উচ্চতর স্কেলের মঞ্জুরী (তৃতীয় শ্রেণি) এবং ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ বরাবর যেকোন ফরওয়ার্ডিং প্রেরণের জন্য দেড় হাজার করে ঘুষের টাকা দিতে হয়। টাকা দিতে বিলম্ব হলে তাদের আবেদনও তিনি মঞ্জুর করেন বিলম্বে ভূতাপেক্ষভাবে।
রওশন জামিল নামে পরিবার কল্যাণ সহকারী (প্রাক্তন) অভিযোগ করেছেন, তিনি পিআরএলে থাকাবস্থায় সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের অর্থ উত্তোলনের জন্য আবেদন করেন কিন্তু ওই আবেদন ফরওয়ার্ডিংয়ের জন্য ধার্য্যকৃত পনেরশো টাকা ঘুষ দিতে অস্বীকার করেন। একারণে জেলা কার্যালয় হতে সাড়ে পাঁচ মাস পর গত ৯ সেপ্টেম্বর আবেদনটি বিভাগীয় কার্যালয়ে পৌছে। অথচ উপপরিচালক মাহবুবুল ইসলামের স্বাক্ষর করা হয়েছে ২৫ মার্চ তারিখে। এ ছাড়া ঘুষের টাকা দিতে হওয়ায় তার পেনশন ও আনুতোষিক মঞ্জুরের আবেদনটি পাঁচ মাস পর ভূতাপেক্ষভাবে স্বাক্ষর করে ফরোয়ার্ডিং করা হয়েছে। মোর্শেদা খানম নামে আরেকজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার অভিযোগ, পিআরএল মঞ্জুরীর জন্য তাকে ১২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। বিধান মন্ডল নামে একজন অফিস সহায়ক কাম নিরাপত্তা প্রহরী অভিযোগ করেন, অফিস সহায়ক পদে পদায়নের আবেদন ফরওয়ার্ডিংয়ের জন্য তার কাছ থেকে উপপরিচালকের নির্দেশের কথা বলে পনেরশো টাকা ঘুষ নিয়েছে। মধুখালি উপজেলা কার্যালয়ের অফিস সহায়ক আজাদ ফকির জিপিএফ অগ্রিম মঞ্জুরীর জন্য আবেদন করলে জেলা কার্যালয় হতে তিন হাজার টাকা ঘুষ দিতে বলে। না দিলে কারণ দর্শানোর নোটিশ করার হুমকি দেয়ার পর তিনি এক হাজার টাকা ঘুষ দেন।
ফরিদপুরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের একজন নার্সকে বদলির জন্য দশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বলে তারা জানান। বদলির জন্য সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকাও ঘুষ পর্যন্ত দিতে হয় ক্ষেত্রভেদে। ইউনিয়ন পর্যায়ের এফপিআই এবং পরিবার কল্যাণ সহকারীরা জানান, তাদের উচ্চতর স্কেল মঞ্জুরীর জন্য প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার মৃত্যুর পর তার সন্তানের প্রতিব›দ্ধী সনদ সিভিল সার্জনের নিকট ফরওয়ার্ডিং জন্যও ঘুষ দিতে হয়েছে বলে অভিযোগে জানানো হয়। পরিবার কল্যাণ সহকারী (পিআরএল ভোগরত), সবিতা রানী সরকার, মীরা রানী ঘোষ, গীতা রাণী গুহ, সুষমা রানী বল, খালেদা আক্তার, রেহেনা সুলতানা, নাসিমা আক্তার, চঞ্চলা রানী পোদ্দার, আয়া বাসনা খাতুন, মজিরুন নেছা, সালেহা বেগম, নিরাপত্তা প্রহরী মোঃ খবির উদ্দিন, মোঃ আবদুল গফুর সহ অসংখ্য ব্যক্তির অভিযোগ, তাদের প্রত্যেককেই ফরোয়ার্ডিংয়ের জন্য ধার্যকৃত অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়েছে।
এছাড়া কর্মচারীদের সাজপোষাকের বরাদ্দ কম দেয়া, ফার্নিচার খাতের বরাদ্দ ৬০ হাজার টাকা সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করা ছাড়াও ভূয়া ভাউচার করে অফিসের টয়লেট পেপার, হারপিক, ফিনাইল, তোয়ালে, অফিস স্টেশনারীর মতো বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয়ে চরম দুর্নীতির অভিযোগ করেন তারা। গাড়ি চালক জব্বার মোল্যা বলেন, উপপরিচালকের সরকারী গাড়ি ব্যবহার না করেন অথচ গাড়ির কাজের ভূয়া বিল করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সময়মতো সার্ভিসিং না করায় গাড়িটি অচল হওয়ার পথে।
বিভিন্ন এনজিওর অনুকূলে সরকারের অনুদান ছাড় করাতে উপপরিচালককে ঘুষ দিতে হয়েছে বলে তারা জানান। একটি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, ৭৫ হাজার টাকা অনুদানের বিল ভাউচার অনুমোদনের জন্য তাকে সাত হাজার টাকা দিতে হয়েছে উপপরিচালককে। এ ছাড়া অনুদানপ্রাপ্তীর আবেদনের সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্যও ১ হাজার হতে ক্ষেত্রভেদে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ ব্যাপারে উপপরিচালক পরিবার পরিকল্পনা মোঃ মাহবুবুল ইসলামের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদকের নিকট তার বিরুদ্ধে আনীত ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি কারও নিকট হতে কোন ঘুষ নেই না কিন্তু আমার কথা বলে আমার অফিসের হয়তো কেউ ঘুষ নিয়ে থাকতে পারে। তবে তারা কেউই আমার নিকট কোন অভিযোগ করেন নি। এ ছাড়া তিনি অন্যান্য অভিযোগও অস্বীকার করেন।