সন্তুষ্টি হলো সুখের মূল চাবিকাঠি। অন্যের দিকে না তাকিয়ে আমরা যদি নিজেদের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতাম তাহলে কখনোই আমাদের মনে অসুখ বাঁধতো না। ভেতরে কখনো ‘নাই’ ‘নাই’ হাহাকারও তৈরি হতো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের ভেতর থেকে সন্তুষ্টি নামক উপাদানটি উধাও হয়ে গেছে। আমাদের সমাজে এখন চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অন্যকে ঠকিয়ে হোক, আর যেভাবেই হোক, অল্প সময়ের মধ্যে আমরা হতে চাই প্রভূত টাকা-পয়সার মালিক। এই অসুস্থ মানসিকতার ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধ।
প্রতারণা বা অন্যকে ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরেই ছিল, তবে বিগত একদশকে এ যেন এক সামাজিক ব্যাধিতেই রুপান্তরিত হয়েছে। একযুগ আগেও প্রতারকরা সমাজে ঘৃণিত মানুষ হিসেবেই পরিচিত হতো। কিন্তু আজকাল প্রতারক, শঠ, বাটপার, জোচ্চোরদের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রাটি যেন পালটে গিয়েছে। সেই সাথে এর রুপটিও ভিন্ন মাত্রায় বিকশিত হয়েছে। অর্থাভাব, বেকারত্ব, দরিদ্র্যতা ইত্যাদি নানা মাত্রার অসহিষ্ণুতায় একসময় মানুষ জড়িয়ে যেতো প্রতারণায়। এ ক্ষেত্রে অর্ধ শিক্ষিত, দরিদ্র বিপথগামী মানুষগুলো প্রতারণাকে বেঁচে থাকার অবলম্বন মনে করতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজ এ ধরণের মানুষগুলোকে করুণার চোখে দেখতো। তবে কোন কালেই এরা সমাজপতি সেজে সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা যেমন করেনি ঠিক তেমনি প্রতারণাকে পেশা হিসেবে বেঁচে নিয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে কারও নিয়ন্তা হওয়ারও চেষ্টা করেননি। আর এখন জোচ্চোরি, বাটপারি হয়ে উঠেছে উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীদের পেশা। তাদের শঠতার বলি হচ্ছে সাধারণ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষ।
একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, যখন থেকে শিক্ষিত, মেধাবী আর চৌকসরা প্রতারণাকে পেশা হিসেবে বেঁছে নিয়েছে, অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে রাজনীতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে, তখন থেকেই প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকীকরণ শুরু হয়েছে। আর এমন দুষ্ট চক্রের সামাজিকীকরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হচ্ছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ। ‘যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি’র কথা আমরা নিশ্চয় কেউ ভুলিনি। এই চক্রটি প্রায় চার লক্ষ গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা, যার সরাসরি প্রভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় দেড় কোটি প্রান্তিক মানুষ। এই প্রতারণার অনুসন্ধানে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন কে প্রধান করে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিশন, এবং ২০১১ সালে রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে আরও একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল তখন। প্রশাসক নিয়োগ করে বার বার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আলোচিত হলেও আইনি মারপ্যাচ আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আজও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
এমএলএম কোম্পানি আইনের সুযোগ নিয়ে গঠিত ডেসটিনি, ২০০০-২০১২ সালে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় আমজনতার ৫ হাজার কোটি টাকা। গ্লোবাল গেইন ইন্টারন্যাশনাল ১৩ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে আড়াইশো কোটি টাকা। ডিজিটালাইজেশনের সুযোগ নিয়ে প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকীকরণের বর্ধিত সংস্করণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ই-কমার্স। যার সুযোগ নিয়ে নোভেরা প্রোডাক্টস ৪০ হাজার ডিস্ট্রিবিউটর নেয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। ২০ হাজার লোককে চাকুরী দেয়ার কথা বলে লাইফওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড হাতিয়ে নেয় ৭০ কোটি টাকা। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ এর হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতারণার খবরে তো এখনো হাজার হাজার গ্রাহকের আহাজারিতে রাজপথ উত্তপ্ত। প্রতারণার প্রাতিষ্ঠানিকিকরণের এমন অবারিত সুযোগ পৃথিবীর অন্য কোন সমাজে কি আছে?
প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকার-ই দেশের জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানে সাংবিধানিক ভাবেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অর্থনৈতিক প্রতারণা যখন সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠে, সাধারণ মানুষকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন রাষ্ট্রীয় বিধি বিধানের কঠোরতা ছাড়া এর প্রতিকার করা সম্ভব হয় না। শুধুমাত্র একটি দেশের সরকার প্রধান হিসেবে নয় জাতির জনকের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ হাসিনার সরকারের কাছে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার পরিমাণটাও বেশি। তাই এই সরকার ডিজিটালাইজেশনের সুযোগে ই-কমার্সের নামে যারা প্রতারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।