বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ হলো কৃষি। শ্রমশক্তির ৪০.৬ শতাংশ মানুষ কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি জমির পরিমাণ দিনদিন কমছে। মাত্র ৮৬ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি থেকে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের অন্নসংস্থান হচ্ছে। করোনা ও বন্যার দুর্যোগ কাটিয়েও গত বছর কৃষক ক্ষেতে ভালো ফসল, বিশেষ করে আমন ফলাতে পেরেছিলেন পর্যাপ্ত পরিমাণে। এটি সম্ভব হয়েছে নির্ধারিত দামে সার, বীজ ও অন্যান্য সামগ্রী পাওয়ার জন্য। এবার আমন ফলনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় অকালবন্যা দেখা দেওয়ায় সেখানকার কৃষকেরা কিছুটা সমস্যায় পড়েন। কিন্তু সেই সমস্যা না কাটতেই তাঁদের সামনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরিয়া সারের বাড়তি দাম।
দেশের চারটি জেলায় ইউরিয়া সারের দাম অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি হয়েছে যশোর জেলায়। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ইউরিয়া সারের সরকার নির্ধারিত দাম ৮০০ টাকা। অথচ সেই সার ক্ষেত্রবিশেষে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি দামে। ফরিদপুরের কৃষকদের প্রতি বস্তা সার কিনতে হচ্ছে ৯০০ টাকা দিয়ে। প্রতি কেজি ১৬ টাকার বদলে কিনতে হয়েছে ১৮ টাকায়। মৌসুমের মাঝামাঝি এসে নওগাঁরডিলাররা সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন লাগামহীনভাবে। বস্তায় ৬০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। টাঙ্গাইলের কৃষকেরা পড়েছেন দ্বিবিধ সমস্যায়। একদিকে বাড়তি দাম, অন্যদিকে বস্তায় দুই কেজি সার কম।
এই চার জেলায়ই যে কৃষককে বাড়তি দাম দিয়ে সার কিনতে বা ওজনে ঠকতে হচ্ছে, তা নয়। বেশি দামে ইউরিয়া সার বিক্রির অভিযোগ এসেছে গাজীপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, পঞ্চগড়, মেহেরপুর, কুষ্টিয়াসহ অনেক জেলা থেকেই। সার এমন পণ্য, যা দু-এক দিন পরে খেতে দিলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। তাই কৃষক বেশি দামে হলেও সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে আমন মৌসুমে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার লাগে। সেপ্টেম্বর মাসে ইউরিয়া বেশি ব্যবহৃত হয়। সারা দেশে এ মাসের জন্য চাহিদা ১ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাকি সার কবে বরাদ্দ দেওয়া হবে, সেটা জানা খুব জরুরি। আমন চাষের জন্য কৃষকের যে সার প্রয়োজন, তার পুরোটা জোগান থাকলে ডিলাররা কৃত্রিম সংকট দেখানোর সুযোগ পাবেন না।
বেশি দামে সার বিক্রির অন্যতম কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিলারশিপ দেওয়া। গ্রামগঞ্জে এখন সেতুর ঠিকাদারি থেকে সারের ডিলারশিপ দেওয়া হয় দলীয় লোকদের। ফলে তাঁদের বেশির ভাগ মনে করেন, কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই কৃষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনও দলীয় লোকদের কিছু বলার সাহস পায় না। একটি দুষ্টচক্রের শিকলে সবার হাত-পা বাঁধা।
কৃষক বেশি দামে সার কিনলে তাঁর উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। ফলে ধানের দামও বাড়বে, যার দায় শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই বর্তাবে। তাই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উচিত হবে ডিলারদের ওপর তদারকি বাড়ানো। যেসব ডিলার বাড়তি দামে সার বিক্রি করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। প্রয়োজনে তাঁদের ডিলারশিপ বাতিল করতে হবে। লিখিত অভিযোগ পাইনি বা দাম বাড়ার কথা নয়, এসব হাওয়া কথা বলে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। নইলে নিঃস্ব হবে কৃষক, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ।