বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী। নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে দূরে রেখে কখনোই কার্যকর ও টেকসই উন্নয়ন সাধিত হতে পারে না। নারীদের অনেকের মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার প্রচ- সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু তাদের সার্বিক সহযোগিতা করা। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন প্রকল্পের জন্য পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। ঋণ পেতে এখনও নারীদের পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। কেউ ঋণ পেলেও তা চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়ার হার পুরুষের চেয়ে বেশি। এরপরও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের ঋণ দেয়ায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অথচ জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-এ বিধান আছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করতে হবে। একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও। সেখানে বলা হয় পুনঃঅর্থায়ন ঋণের কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। কিন্তু এ নির্দেশ গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে কার্যকর হচ্ছে না।
গ্রামে অসংখ্য ছোট ছোট নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ও অনুকূল নারীবান্ধব অবকাঠামো না থাকার কারণে তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বাজারজাতকরণে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে নারী উদ্যোক্তারা পূর্ণাঙ্গ সুফল ভোগ করতে পারছেন না। আরও জটিল সমস্যা হচ্ছে প্রয়োজনীয় ও সঠিক ধারণা এবং তথ্য না পাওয়া। যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি, কর প্রদান, ব্যাংক লোন বা সরকারি সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা এমন নানা বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। আর এসব বিষয়ে নির্ভুল তথ্য পাওয়ার প্রতিষ্ঠান তেমন নেই। পাশাপাশি বিদেশে পণ্য রফতানি করার ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতি প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থ আদান-প্রদানের সহজ ব্যবস্থার তথ্য সঠিকভাবে পেতে দীর্ঘ সময় পার করতে হয়। ফলে একজন পুরুষের সমান যোগ্যতা সম্পন্ন হলেও শুধু গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তা বলে ভিন্ন আচরণের সম্মুখীন হতে হচ্ছে নারীদের। এ ছাড়া নানারকম সুবিধা বা সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই বৈষম্যের শিকার হন গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা। নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার জন্য প্রশিক্ষণ, ব্যবসা পরিকল্পনা প্রস্তুত ব্যবসার প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহের প্রয়োজন হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যবসার পরিকল্পনার বিপরীতে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ অনেক কম।
গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারিকৃত এক সার্কুলারের মাধ্যমে এসএমই সেক্টরের সংজ্ঞা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজকে অঙ্গীভূত করে এসএমই সেক্টরের নতুন নামকরণ করা হয়েছে কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। এর ফলে যারা অতি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তা, তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আহরণের পথ প্রশস্ত হয়েছে। আগে অতিক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তারা ব্যাংক বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের সুবিধা পেত না। তাদের এনজিও অথবা গ্রামীণ মহাজনের কাছে ধরনা দিতে হতো। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।
এছাড়া মন্ত্রিপরিষদের সাম্প্রতিক এক সভায় নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণদানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এ দুটি পদক্ষেপ অতিক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। কিন্তু আইনি সংস্কার সাধন করা হলেও এগুলো এখনো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতায় পড়তে হয়। ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণদানের ক্ষেত্রে মোটেও আগ্রহী নয়। তারা নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ না দিতে পারলেই যেন বর্তে যায়। ব্যাংকারদের এই নেতিবাচক মনোভাব কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাগণ যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ পেতে পারেন তার উদ্যোগ নিতে হবে।
করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় সিএমএসএমই খাতের বিকাশ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। একমাত্র এই খাতের উদ্যোক্তারা, বিশেষকরে নারী উদ্যোক্তারা ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখতে পারেন। একইসাথে বাংলাদেশ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকেও অগ্রগতি লাভ করবে।