বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা স্বাধীনতার পর থেকেই অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭৩ সালে বরেণ্য বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবীদ ড: কুদরতে খোদাকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় যা কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়িত হয়। এরই মধ্যে অনেক পরিবর্তন ও সংশোধন আনা হয়। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়। ২০১২ সালে সর্বশেষ প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। গত ১০ বছরে তার পরিপূর্ন বাস্তবায়ন হয়নি। ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাস্তর নির্ধারন করা হলে ও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি এবং ৫ম শ্রেনীতে পাবলিক পরীক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এছাড়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী একটি শিক্ষা আইন বা এডুকেশন এ্যাক্ট পাশ নাম করার কথা ছিল। অথচ এই আইনের খসড়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, আইনটি আর হয়নি। নীতিমালার ভিত্তিতে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে, বাস্তবায়িত হয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি। এখন নূতনভাবে শিক্ষাক্রমে বড় ধরণের পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হয়েছে চতুর্থ শিক্ষা বিপ্লব ও কোভিড- ১৯ পরবর্তী বৈশি^কভাবে জীবন-জিবীকায় দ্রুত পরিবর্তন হবে। এই ভাবনা থেকে এই পরিবর্তন আনা হচ্ছ্।ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকা, ভূটান এবং ভারত সম্প্রতি শিক্ষা নীতিতে অনুরূপ পরিবর্তন এনেছে। ইতোমধ্যে কলকাতা মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারী করেছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রেরণ করেছে। এনসিটিবি (National Curriculam & Text Book Board) বা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ভাষ্যমতে বিশে^র অন্তত: ৫১ টি দেশ রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা ও যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে। তাই আমরাও নূতন বৈশ্বিক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বা তাল মিলিয়ে নূতন শিক্ষাধারা চালু করব। এর রূপরেখা ও নীতিমালা আমাদের জন্য কতটুকু কার্যকর ও সফল হয় তা আলোচিত হল।
গত ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর নিকট জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার খসড়া উপস্থাপন করা হলে তা অনুমোদিত হয়। এরপর শিক্ষামন্ত্রী ডা: দিপু মনি প্রস্তাবিত নূতন শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম (Carriculum) এ্র বিভিন্ন দিক নিয়ে মন্ত্রনালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। জাতীয় শিক্ষাক্রমে বড় ধরণের পরিবর্তন আসছে। নূতন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাকেন্দ্রীক ও আনন্দময় শিক্ষার উপর জোর দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বাড়ীর কাজ, এসাইনমেন্ট এবং পরীক্ষা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ও ভীত থাকে। তাই এদের উপর থেকে পরীক্ষা ও বইয়ের বোঝা কমানোর জন্য এবং শ্রেনী শিক্ষা ও এর উপর ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকছে। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কোন পাঠ্যবই থাকবে না, শিক্ষাকরাণই পাঠপরিকল্পনা করে শেখাবেন। ছাত্র-ছাত্রীদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শ্রেনী পাঠদান সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে করা হবে, বিদ্যালয়েই যাতে তারা শিক্ষনের কাজটা সেরে ফেলতে পারে সেভাবেই শিক্ষাক্রম সাজানো হবে। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার পাশাপাশি ক্লাসরুমের ধারাবাহিক মূল্যায়নের গুরত্ব দেয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে (৪র্থ থেকে ৮ম শ্রেনী) শ্রেনী শিক্ষার মূল্যায়ন হবে শতকরা ৬০ ভাগ আর বছর শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে ৪০ ভাগ। এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে বাংলা, ইংরেজী, গনিত, সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়। ধর্ম ও শারীরিক শিক্ষাসহ অন্য কোন বিষয়ের কোন বিষয়ের কোন পরীক্ষা হবে না। ২০২৫ সালে এই শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে এবং ২০২৩ সালে বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২২ সাল অর্থাৎ আগামী বছর থেকে প্রাথমিক স্তরে (১ম শ্রেণী) ১০০টি এবং মাধ্যমিকে (৬ষ্ঠ শ্রেণী) ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই শিক্ষাক্রমের পাইলটিং বা পরীক্ষামূলক প্র্যাকটিস করা হবে। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ২০২৩ সালে প্রাথমিকে ১ম ও ২য় শ্রেনীতে এবং মাধ্যমিক ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেনীতে এই শিক্ষাক্রম শুরু হবে। ২০২৪ সালে ৩য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীতে পাঠদান শুরু হবে।২০২৫ সালে ৫ম ও ১০ম শ্রেণীতে কার্যকর করা হবে। ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেনীতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেনীতে নূতন শিক্ষাক্রম চালু হবে।
প্রস্তাবিত কারিকুলাম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না, থাকবে না পিএসসি, জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষাও এবং থাকবে না নবম-দশম শ্রেনীতে বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষার মত বিভাগ বা বিভাজন। এতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে একটি কারিগরি ট্রেড কোর্স পড়তে হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী ৯ম শ্রেনীতে বার্ষিক পরীক্ষা হবে এবং ৯ম শ্রেনীর সিলেবাস কোন পাবলিক পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত হবে না। শুধু ১০ম এবং দাখিল শ্রেনীর পাঠ্যসূচীর উপর নেয়া হবে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেনীতে প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানে একটি করে চুড়ান্ত পরীক্ষা হবে। তাতে আবশ্যিক বিষয়গুলোর উপর মূল্যায়ন করা হবে শতকরা ৩০ ভাগ। আর দুইটি পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে ৭০ ভাগ। ঐচ্ছিক বিষয়ের সবগুলোতোই শ্রেনীকক্ষে শিখন ফলের উপর মূল্যায়নকরা হবে। নূতন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক থেকে ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত ১০ ধরনের শিক্ষাক্ষেত্রে নির্ধারন করা হয়েছে ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন-জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স¦াস্থ্য সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি। এরই ভিত্তিতে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে। সেগুলি হচ্ছে বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। নূতন শিক্ষাক্রমে দুই ধরনের মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। একটি হল শ্রেনীকক্ষে পাঠদানকালে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে শিক্ষক কর্তৃক মূল্যায়ন করা হবে সারা বছর ধরে। আরেকটি হল সামষ্টিক মূল্যায়ন যাতে স্কুলে বিভিন্ন সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষার উপর মূল্যায়ন বা নাম্বার প্রাপ্তি হবে। পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে ২০২২ সালে অর্থাৎ আগামী বছর পরীক্ষামূলক শিক্ষাক্রম শুরুর জন্য সারাদেশে শিক্ষক গাইড ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচী চালু করার কথা বলা হয়েছে। পরের বছর থেকে শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষন দেয়া হবে যাতে শিক্ষক গাইড ও প্রশিক্ষন কর্মসূচী ও অর্ন্তভুক্ত থাকবে। খালি পদে নূতন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পর নূতন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রশিক্ষন দেয়া হবে। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষক অবসরে যাবেন। নূতন নিয়মে আগের মত ৯ম ও ১০ম শ্রেনীর সিলেবাস থেকে এসএসসি পরীক্ষা হবে না, হবে শুধু ১০ম শ্রেনীর পাঠ্যসূচীর ভিত্তিতে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেকদূর এবং দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, বৈশি^ক জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। সেই সংগে তাল মিলিয়ে এগিযে যাবার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। তা না হলে চাকরী-ব্যবসার প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে থাকব। তাই প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমকে স্বাগত ও সাধুবাদ জানাই। নি:সন্দেহে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সুচিন্তিত ও গবেষণার ফল প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের রূপরেখা। শিক্ষাকে কষ্ট ও বোঝা হিসেবে না নিয়ে একে আনন্দদায়ক করে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করা প্রস্তাবিত ব্যবস্থার লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু কার্যকর হবে এই ব্যবস্থা তা চ্যালেঞ্জের বিষয়। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে অনেক পদক্ষেপ ও নীতিমালা গ্রহন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। তাই বলা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বারবারই অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের সমাজ ও কৃষ্টির পার্থক্য রয়েছে। সেসব বিবেচনায় কমই আনা হয়েছে। শিখন প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ করা হয়েছে। কিন্তু মান বাড়েনি। ২০১০ সালের আগে এদেশে পরীক্ষা প্রদ্ধতি ভিন্ন ছিল, রচনামূলক পাঠ ও পরীক্ষার উপর জোর দেয়া হত। পরীক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ছিল না, বিকল্প প্রশ্ন কম ছিল যেমন, ৭টির মধ্যে ৫টির উত্তর দিত হত। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়তে বাধ্য হত। বর্তমানে ১০/১২ টি প্রশ্নের মধ্যে ৫টির উত্তর দিতে হয়, তাই অনেক অধ্যায় না পড়লেও চলে। এছাড়া তখন একই দিনে দুই পত্রের পরীক্ষা হত এবং পরীক্ষার মাঝে খুব কম দিনের বিরতি ছিল। ওদিকে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নোত্তরের কারনে নম্বর বেশি পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। অনেক সময় অনুমান-আন্দাজ করে সঠিক উত্তর দেয়া যায়। ফলে পরীক্ষায় পাস করা অনেক সহজ। তারপরও শতকরা ২০/৩০/৪০ ভাগ আকৃতকার্য হচ্ছে। এসবই বিবেচনায় থাকা দরকার।
প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে ৩য় শ্রেনী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষাতংকে ভূগবেনা, অভিভাবকগণও টেনশনমুক্ত থাকবে। পরবর্তী শ্রেনী গুলোতে শিক্ষকগন কর্তৃক ধারাবাহিক মূল্যায়নের উপর জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটি কতটুকু স্বচ্ছ ও সঠিক হবে তাতে সন্দেহ আছে। নীতিহীন ও দুর্বল শিক্ষকগন ইচ্ছেমত মূল্যায়ন করতে পারে। সেক্ষেত্রে অভিভাবকগন ক্ষুব্ধ থাকবে এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে একটা টানপোড়ন ও সংঘাতের সম্ভবনা রয়েছে। শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীকে সুনজরে দেখে এবং কোন শিক্ষার্থীকে পছন্দ না করে অতি বা অবমূল্যায়ন করতে পারে। আরেকটি বিষয় ও বিবেচনায় আনতে হবে। চতুর অভিভাবকগন শিক্ষককে যেকোন ভাবে প্রভাবিত করতে পারে যা কম বেশী এখনো হচ্ছে। আমরা দেখছি পাবলিক পরীক্ষার সময় অভিভাবকদের নকল সরবরাহ করতে। এধরনের মানসিকতায় এই মূল্যায়ন পদ্ধতি কতটুকু সঠিক ও কার্যকর হবে তাতে সন্দেহ রয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ক্লাশের শিক্ষার্থী কর্তৃক সতীর্থদের মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এই দায়িত্ব দেয়া মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সুবিচার হবে না। এটি সম্ভব পেশাগত ও বিভিন্ন বাহিনীর প্রশিক্ষণে যেখানে প্রশিক্ষনার্থীরা পরিপক্ক (Matured) শিক্ষাকে যতই সহজ করা হবে ততই পাশের হার বাড়বে কিন্তু গুনগত মানের উন্নয়ন হবে না। একই দেশ একই ছাত্র সেই পূর্বেও ছিল এখনো আছে। তখন পরীক্ষার নম্বর কম পাওয়া যেত, ৮০% এর উপর নম্বর বা লেটার মার্ক কম ছিল। বিশেষ করে ইংরেজী ও বাংলায় দুরূহ ছিল। প্রতি বোর্ডে বিভাগ ওয়ারী ২০ জন মেধা তালিকায় থাকত যাকে স্ট্যান্ড (Stand) করত বলা হত। চার শিক্ষা বোর্ডে (এখনো বেশী) প্রতি বিভাগে ৮০-১০০ জন (একই স্থানে কখনো কখনো একাধিক ছাত্র-ছাত্রী অবস্থান করত) এবং তিন বিভাগ মিলে অনুর্দ্ধ ৩০০ জন মেধা তালিকায় থাকত। গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হওয়ায় হাজার হাজার, ক্রমান্বয়ে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এ+ বা জিপিএ ৫ পাচ্ছে। মান কি সে অনুযায়ী বেড়েছে? বর্তমান প্রস্তাবনায় শুধু ১০ম শ্রেনীর শিক্ষাসূচীর উপরই এস এস সি পরীক্ষা হবে। ফলে আরো সহজ হয়ে গেল। পড়ার চাপ কমিয়ে দিয়েই শিক্ষা আধুনিক বা মান সম্মত হবে এটা বলা যায় না। শিক্ষার্থীরা যত কম পড়বে বা শিখবে এতই বেশী মেধাশূন্য হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেনীতে প্রতিবছর বোর্ড পরীক্ষা হবে। এর দুটো দিক আছে। দুই শিক্ষাবর্ষের সিলেবাস এইচএসসি পরীক্ষার তুলনায় নূতন ব্যবস্থায় প্রতিবছর শেষে পরীক্ষা হলে চাপ কিছুটা কমবে এবং রেজাল্ট ভাল হতে পারে। তবে এসএসসি ও এইচএসসিতে মিলে পরপর ৩টি বোর্ড পরীক্ষাও একটা চাপের বিষয়। তিন বছরে তিনবারই ফরম পূরণ করা, নির্বাচনী পরীক্ষা দেয়, অতিরিক্ত শিক্ষাব্যয় হওয়া এসবই চাপের বিষয়। এছাড়া, রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন হওয়া বা পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। সেক্ষেত্রে সেশন জট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত অভিন্ন বিষয় অর্থাৎ সব শিক্ষার্থীর জন্য এই ১০টি বিষয় শিক্ষা একটি সঠিক প্রস্তাব। কেননা, এসএসসি পাশ একজন শিক্ষার্থী সবগুলো বিষয় বা দিকের উপর একটা প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করবে বা প্রাথমিক ধারণা পাবে। নূতন রূপরেখার বাধ্যতামুলকভাবে একটি কারিগরি ট্রেড কোর্স অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর জন্য যে অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন এর যোগান দেয়া সব প্রতিষ্টানের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ বিষয়টি বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকরাই মুল ভূমিকা পালন করবেন। তাঁদের মূল্যায়নের উপরই নির্ভর করবে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়া, মেধা যাচাই এবং তাদের ভবিষ্যৎ। এই প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত সংখ্যক এবং যোগ্য শিক্ষক থাকা দরকার। তাহলেই আমাদের উচ্চভিলাসী শিক্ষাক্রম সফল হবে। কিন্তু আমাদের কি তা আছে? প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় পর্যায়েই হাজার হাজার শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। নূতন শিক্ষাক্রমে যে ধারাবাহিক মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবায়নে শ্রেনীকক্ষে শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত হওয়া উচিত ১:২৫ অন্তত; ১:৩০। তা নাহলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর দিকে নজর দেয়া ১ জন শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই পাইলটিং পর্বেই অর্থাৎ আগামী বছরের মধ্যে খালি পদ পূরণ করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত: শিক্ষকদের জন্য যে প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে তা যথাযথ হওয়া প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ লাভের পরও তা কার্যকর করা হয় না। শুধু পেশাগত উন্নতির জন্য প্রশিক্ষন নেয়া হচ্ছে। এদিকটাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহন করতে হবে। সর্বোপরি যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন তা হল আমাদের দেশে শিক্ষকদের মান। এদিকটায় আমরা বড্ড নাজুক অবস্থায় রয়েছি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষকতায় মেধাবীরা আসে না সুযোগ-সুবিধার অভাবে। বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বলা যায় অবেহেলিত। মেধাবীরা সরকারী বা ক্যাডার সার্ভিসে যাওয়ার চেষ্টা করে অথবা প্রাইভেট বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী পাওয়ার চেষ্টা করে। তাই আজকাল বিবিএ-এমবিএ করার প্রবণতা বেশী যাতে লাভজনক চাকরী পাওয়া যায়। সামাজিক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বাজার দর কম। একটি উদাহরনই দেয়া যায়। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে নিয়োজিত অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরী পেলে চলে যায়। কেননা সেখানে একটা বেতনের স্কেল আছে, চাকরীর নিশ্চয়তা আছে, পেনশন আছে। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকর্ষণ করতে না পারলে কোন শিক্ষানীতিই বাস্তবায়িত হবে না। পৃথিবীর যে কোন দেশে শিক্ষকদের মান-মর্যাদ্রা আমাদের তুলনায় অনেক উঁচুতে। নূতন কারিকুলামে এদিকটির উপর বিশেষ দৃষ্টি দেয়া দরকার। মেধা ও শিক্ষা অনুযায়ী তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারন করা উচিত। এমনকি প্রাথমিক-মাধ্যমিকে নিয়োজিত (যদি কেউ করতে চায়) একজন পিএইচডি করা শিক্ষকের বেতন নির্ধারণ করা উচিত তাঁর মত অন্য ক্ষেত্রে যারা নিয়োজিত তাঁর মত। দীর্ঘ গবেষণা ও পর্যালোচনার উপর যে নূতন শিক্ষাক্রম প্রনীত হয়েছে তার বাস্তবায়নে চাই সেই পরিবেশ ও সেই মানের শিক্ষক।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক