দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জলাশয়ে বিলুপ্ত প্রায় লাল শাপলা। নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ সবার চেয়ে বেশী। বর্ষা মওসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত বিল-ঝিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় লাল শাপলা। আবহমান কাল থেকে শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এক সময় খালে-বিল ও বদ্ধজলাশয় বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা জন্মাত। তবে ৯০ দশকের পরবর্তীতে সময় খুলনার কয়রাসহ পাশ্বর্তী উপজেলা গুলোতে ব্যাপকভাবে লবণ পানিতে চিংড়ি চাষ শুরু হলে বিলুপ্ত হতে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল একটি প্রিয় খেলনার পাশাপাশি অনন্ত সৌন্দেয্যর আকর্ষণ।
গত শুক্রবার বিকালে ৬নং কয়রা গ্রামের বিমল মন্ডলের সাথে কথা হলে তিনি জানান, দু’দশক আগেও বর্ষাকাল থেকে শরৎকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত বিল এলাকায় বিলের পর বিল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম রক্ত শাপলা বা লাল শাপলা। বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদমাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারী রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। মনে হত কোনো এক সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট জীব হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। এদৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। ওইসব লাল শাপলার বিলে ছুঁটে আসতেন প্রকৃতি প্রেমীরা। অনেকে আবার শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে বিক্রি করতো। বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনগণের চাপের কারণে আবাদি জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে বিলের পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে। পাশ্বর্তী উপজেলা সহ পাইকগাছাতে লবণাক্ত প্রভাবে বিলুপ্ত প্রায় লাল শাপলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ। তাছাড়া জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারনে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাটের কারনে জেলার বিলাঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা। এখন খাল-বিল ও জলাশয় থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা। অনেকে সৌন্দয্যের জন্য পুকুরেও চাষ করত লাল শাপলা। তবে ওই সকল পুকুরে কার্প জাতীয় মাছ যেমন-রোবোকার্প, গ্রাস কার্প মাছ চাষের ফলে শাপলার বংশ বিস্তার সমূলে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি অফিসার মোঃ আয়ুব আলী বলেন,সাধারণত শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাদা, বেগুনী (হুন্দি শাপলা) ও অন্যটি লাল রংয়ের। এরমধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-শবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুন অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুন বেশি। শাপলা চুলকানী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। তাছাড়া ডায়াবেটিস, বুক জ¦ালা, লিভার, ইউরিনারী সমস্যার সমাধান সহ নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি ১শ’ গ্রাম শাপলার লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, এ্যাশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলো, ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শক্ররা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাই মেটার ৮.৪, ক্রুড আমিষ ১৬.৮, ক্রুড ফ্যাট ২.৮ ক্রুড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ।
কপোতাক্ষ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অ.ব.ম আঃ মালেক বলেন, ঐতিহাসিক কাল থেকেই শাপলার ফল (ঢ্যাপ) দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খৈ ভাজার রেওয়াজ আছে। যেটি গ্রামগঞ্জে ঢ্যাপের খৈ বলে পরিচিত। মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিল-ঝিল-হাওড়-বাঁওড়-পুকুরের পানি যখন কমে যায় তখন শালুক তুলে খাওয়া হত, তা খেতেও বেশ সুস্বাদু এবং আমাশয়ের জন্য এটি খুবই উপকারী। সরকারিভাবে উদ্যোগ না নিলে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত ভূমি ও জলাশয় থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ লাল শাপলাসহ অন্যান্য উদ্ভিদ । এ জন্য সকলকে এগিয়ে আশা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।