বাংলাদেশ সহ উন্নত বা অনুন্নত বিশে^র বিভিন্ন দেশে আতœহত্যার প্রবণতা একটি আতঙ্কিত বিষয়। তার চেয়েও আতঙ্কের বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের আতœহত্যার প্রবণতা। দেশের যারা কান্ডারি, দেশকে এগিয়ে নিতে যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তারা কেন আতœহত্যার পথ বেছে নেবে? এখানে মানসিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন কারণে বর্তমান সময়ের তরুণ-তরুণীরা বিষন্নতায় ভুগতে থাকে। ক্যারিয়ার,সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে মানসিক চাপে থাকে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া চার শিক্ষার্থীর আতœহত্যার ঘটনায় আতœহত্যার মহামারী সামনে চলে এসেছে। এইসব মেধাবী মুখ এভাবে চলে যাওয়া আমাদের আতঙ্কিত করে। শুধু এই চার ঘটনাই নয়, এক তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রায় ১৮ মাসে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আতœহত্যা করেছে। আতœহত্যার কারণ হিসেবে হতাশা, পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, নিজের পায়ে দাড়ানোর ব্যর্থতা,প্রেম প্রভৃতি কারণে আতœহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। আতœহত্যা কোনো সমাধান না হলেও সারা বিশে^ই কম-বেশি আতœহত্যার প্রবণতা রয়েছে। মানুষ কেন আতœহত্যা করে তার একেবারে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে আতœহত্যা মানসিক শক্তির সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত। পেছনের কারণ যা-ই হোক যখন ধৈর্য রাখতে পারে না এবং সমস্যা সমাধানে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে বিশ^াস করতে শুরু করে তখনই সে আতœহত্যার পথ বেছে নেয় বা নিতে পারে। অভাব কেবল বস্তুগত চাহিদার নয় বরং মনেরও বটে। কারণ বিশে^র অন্যতম ধনী ও উন্নত রাষ্ট্র যেখানে সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে সেই জাপানে কিন্তু আতœহত্যার ঘটনায় সর্বোচ্চ হারের দেশগুলোর মধ্যে একটি। কেউ সবকিছু পেয়ে আতœহত্যা করছে আবার কেউ কিছু না পাওয়ার ক্ষোভে আতœহত্যা করছে। আতœহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি এমন এক মানসিক অবস্থা পৌছে যায় যখন সে বাস্তব যুক্তিতর্কের বিবেচনা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে আতœহত্যা করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। আতœহত্যা একটি অপ্রত্যাশিত এবং অমিমাংসিত সমাধান। যদিও সাময়িকভাবে আতœহত্যাকরীরা তাদের জীবনের নানামুখী সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয় তথাপি তারা নিজেদের সরিয়ে নিয়ে পরিবার পরিজনদের আরও বেশি চাপের ভেতর ফেলে দেয়। নিজেকে ধ্বংস করার ভেতর যে কোন বীরত্ব নেই বরং তা নিজ পরিবারের জন্য হতাশাদায়ক। এটি কোনভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু আমরা যত এগিয়ে চলেছি আতœহত্যার পথ বেছে নেয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অতি তুচ্ছ কারণেও এইসব আতœহত্যার ঘটনা ঘটছে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর পত্রিকার পাতায় আতœহত্যার খবর আসে। প্রতি বছর এটা যেন কমন বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। আদৌ পরীক্ষার ফলাফল দেখে আতœহত্যা করার কিছু আছে কি। সবাই একটা ফল প্রত্যাশা করে কিন্তু সবার প্রত্যাশা যে একেবারে স্বপ্নের সাথে মিলে যাবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। এক্ষেত্রে প্রত্যাশার চাপ, তা পূরণ না হওয়া এবং তা থেকে মুক্তি পেতেই আতœহত্যার মত ঘটনাটি ঘটছে।
সামান্য মানসিক উদ্বিগ্নতা তৈরি হলেই মানুষ আতœহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিষয় তা হলো মানুষের মানসিক শক্তি কমেছে। ফলে সবার আগে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি বা নিজের ওপর আতœবিশ^াস ধরে রাখার শিক্ষা দেওয়া জরুরি। একেবারে শুরু থেকেই এই কাজটি করা যেতে পারে। সন্তান বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তাকে সফলতা এবং ব্যর্থতা দুই দিক সম্পর্কেই ধারণা দিতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে জীবনে যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই আসুক তা ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। এক্ষেত্রে পৃথিবীতে ব্যর্থ থেকে সফল হওয়া মানুষের যে দীর্ঘ তালিকা রয়েছে সেসব উপস্থাপন করতে হবে। তাদের জীবনি থেকে শিক্ষা নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। দুঃখের ব্যাপার হলো যে সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত সহজ সে সমস্যার জন্যও আতœহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে যে কারণেই আতœহত্যা করুক না কেন তা কোনভাবেই কাম্য নয়। আবার শুধুমাত্র আতœহত্যার চেষ্টা করে তা থেকে বেঁচে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি। আতœহত্যার প্রবণতা ক্রমেই একটি সামাজিক ব্যাধীতে পরিণত হয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছেলে বা মেয়ে তুচ্ছ কারণে আতœহত্যা করছে। যার সামনে অবারিত ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে, যার হাত ধরে দেশ এগিয়ে যেতে পারে তারা এভাবে চলে যেতে পারে না। মা-বাবার ওপর রাগ করে বা তার পছন্দের জিনিস না পেয়ে হতাশ হয়ে আতœহত্যা করছে। মোট কথা আতœহত্যার কারণ বিভিন্ন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আতœহত্যা একটি মহাপাপ। নিজের জীবন শেষ করার ভেতর কোন সমাধান লুকিয়ে নেই। আজকাল অনেকেই রীতিমত ঘোষণা দিয়ে আতœহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে আতœহত্যা করছে অনেকে। প্রশ্ন হলো আমাদের এই প্রজন্মের এইসব মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি আতœহত্যার মত অপ্রত্যাশিত অপরিমাণদর্শী চিন্তাভাবনার পথ বেছে নেয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আমরা কোথায় দাড়াব। একেকজন একেক কারণে জীবনের এই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আজকাল মানসিক চাপকে অনেকেই দোষারপ করছেন। বর্তমান প্রগতির যুগে অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের উপর মানসিক চাপ বাড়ছে কিন্তু আতœহত্যা মানসিক চাপ কমানোর যে কোন সমাধান নয় বরং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সে কথা বুঝতে হবে। আমাদের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে তাদের সমস্যা এবং উৎসাহ নিয়ে কাজ করা। নিজেকে শেষ করে কোন সমস্যার সমাধান আশা করাটা বোকামি বরং সমস্যার মাঝে থেকে সমস্যাকে বাধাকে অতিক্রম করতে হয়। এটাই নিয়ম। নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলে কোন সমাধান হয় না।
আতœহত্যা প্রতিরোধে সমাধান কোথায়? কিভাবে এই সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আতœহত্যার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। তারপর সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। জীবনে হতাশ হওয়ার যেমন কারণ রয়েছে তেমনি জীবনকে ভালোবাসার মতো কারণও রয়েছে প্রচুর। বর্তমান সমাজে হতাশা নামক ব্যধি খুব সহজেই মানুষের মনে বাসা বাঁধছে। এই হতাশা কাটাতেই অনেকে আতœহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন হালকা হওয়ার সাথে সাথে এসব হতাশ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সামাজিক অস্থিতিশীলতা, চাকরির বাজারের অস্থিরতা,সম্পর্কের টানাপোড়েন,বিশ^াস ও মূল্যবোধের অভাব,ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধের অনুপস্থিতি,মাদকদ্রব্যের বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়া,সন্তানের বেড়ে ওঠায় একাকিত্ব এসব কিছুই তার ব্যক্তির জীবনের ওপর শ্রদ্ধাবোধ আলগা করতে ভূমিকা রাখে। জীবনকে ভালোবাসার চেয়ে ভালো আর কোনো কিছুই হতে পারে না। প্রথমে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে হবে। মানসিক শক্তি বাড়াতে হবে। জীবন একটি ঘটনায় থেমে থাকে না। প্রত্যেকেরই কিছু করার সুযোগ থাকে। সেই সুযোগ সম্পর্কে তাদের বোঝাতে হবে। সবচেয়ে ভালোবাসার বিষয় হলো নিজের জীবন- এই সত্যটি তাদের অনুধাবন করতে হবে।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক, কলামিষ্ট, পাবনা