আমাদের জানামতে সভ্য কোনো দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের প্রয়োজন পড়ে না। এসব উদ্ভট অভিযান ছাড়াই সে সব দেশের সড়ক যে ফিটনেসবিহীন গাড়িমুক্ত থাকে তার কারণ একটাই। আর তা হলো ট্রাফিক পুলিশের সততা। সে সব দেশে এমপি-মন্ত্রীদের গাড়িও আইন ভঙ্গ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের দেশে যা কল্পনারও বাইরে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল বন্ধ করতে হলে অভিযান চালিয়ে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলা নয়, সততার সংকট থেকে বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হবে। তারা তৎপর হলে রাজধানী লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির অত্যাচার থেকে মুক্ত হবে।
ঢাকা ও এর আশপাশে ২০০-র বেশি রুটে সাড়ে তিন হাজার বাস চলাচল করে। অনুমতি রয়েছে ১২ হাজার ৫২৬টি বাস চলাচলের। দেখা যায়, যাত্রী তোলার জন্য এক বাসের চালক অন্য বাসের সঙ্গে পালস্নায় লিপ্ত হন। এর ফলে দুর্ঘটনা বাড়ে। এই ব্যবস্থা পরিবর্তনে ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহণ পরিকল্পনায় 'বাস রুট রেশনালাইজেশন' বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে লক্কড়-ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়া। সহজ শর্তের ঋণে নতুন বাস নামানো। বাস চলবে পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির অধীনে। মালিকরা বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পাবেন।
২০১৬ সালের শুরুতে এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক। তখন পরিকল্পনা ছিল দেড় বছরের মধ্যে ছয়টি কোম্পানির অধীনে ছয় রঙের নতুন তিন হাজার বাস নামানো হবে। তার মৃত্যুর পর উদ্যোগটি থেমে যায়। পরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন উদ্যোগটি নতুন করে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে। ২০১৯ সালে অন্য একটি প্রজ্ঞাপনে ডিএনসিসির একজন প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে ১২ সদস্যের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে পরীক্ষামূলক বাস চলাচল শুরুর কথা ছিল। পরে সেটি পিছিয়ে সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
সব কিছু স্বাভাবিক গতিতে চললেও পরীক্ষামূলকভাবে ঘাটারচর থেকে কাচপুর রুটে রেশনালাইজেশনের অধীনে গণপরিবহণ চালাতে অন্তত আরও ছয় মাস লাগবে। বাস চলাচলের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো তৈরি করা দরকার সেটা এখনো করা যায়নি। ঘাটারচরে যেখানে বাসের ডিপো তৈরি হবে, সেই ডিপোর জমি এখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি। এই একটি রুটের সফলতার ওপর নির্ভর করছে বাকি ৪১টি রুটের ভবিষ্যৎ। এই পথে ৪০টি বাস স্টপেজ থাকবে। এর বাইরে বাস দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে আরও ১৭টি। থাকবে ৪০টি যাত্রীছাউনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা মূলত বড় কোম্পানির বাসমালিক, সিটি করপোরেশন ও ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষের যৌথ ব্যর্থতার ফল। তাদের সদিচ্ছার অভাব আছে বলেই এখন পর্যন্ত একটি রুটেরই অবকাঠামো ঠিক করা সম্ভব হয়নি। রাজধানীর সড়ক পরিবহণে শৃঙ্খলা আনতে বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যকর হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ রাজধানী দূরের কথা দেশের কোথাও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলুক তা চাইতেও পারেন না। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি বছরের পর বছর ধরে চলছে যা ওপেন সিক্রেট। যে কারণে রাস্তায় ধোঁয়া ছেড়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও ত্রম্নটিযুক্ত গাড়ির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জানালা-দরজা ভাঙা গণপরিবহণও রাজধানীজুড়ে অবাধে চলে সব সম্ভবের এই দেশে। যাত্রীরা এমন যানবাহনে চলাচলকে তাদের নিয়তির লিখন বলে মেনেও নিয়েছেন। সে লিখন খন্ডানো নয়, যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বাড়ানোর জন্যই যেন অভিযান চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে। যারা এগুলো চলতে দেন অভিযানের সঙ্গে সেসব কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতায় আশঙ্কা করা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এটি হয়তো অশ্বডিম্বই প্রসব করবে।
আমাদের জানামতে সভ্য কোনো দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের প্রয়োজন পড়ে না। এসব উদ্ভট অভিযান ছাড়াই সে সব দেশের সড়ক যে ফিটনেসবিহীন গাড়িমুক্ত থাকে তার কারণ একটাই। আর তা হলো ট্রাফিক পুলিশের সততা। সে সব দেশে এমপি-মন্ত্রীদের গাড়িও আইন ভঙ্গ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের দেশে যা কল্পনারও বাইরে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল বন্ধ করতে হলে অভিযান চালিয়ে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলা নয়, সততার সংকট থেকে বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হবে। তারা তৎপর হলে রাজধানী লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির অত্যাচার থেকে মুক্ত হবে।
তারা সততার সংকটে না ভুগলে লাইসেন্স ছাড়া কারোর পক্ষে গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সততার দ্বারা পরিচালিত হলে রাজধানীতে যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী নেওয়া ও যানজট সৃষ্টি করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তা না করে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করলে জনদুর্ভোগই শুধু বাড়বে। সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তিই নিশ্চিত করা হবে; যা হওয়া উচিত নয়।
আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ