বিশ্ব অর্থনীতিতে যেন করোনা তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে সে বিষয়েও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কাজ করতে হবে একসঙ্গে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে একে অন্যের প্রতি। বিশেষ করে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পাশে দাঁড়াতে হবে সবার আগে।
শেষ হয়েছে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ। দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে এ সময় বেশ বেগ পেতে হয়েছে সবাইকে। বিশেষ করে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত করোনার ব্যাপকতা দেখেছে বাংলাদেশ। এ সময় প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। হয়েছে নতুন নতুন রেকর্ডও। এখন মৃত্যু ও আক্রান্তের হার অনেকটা কমলেও করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্ক সেভাবে কমেনি। শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনাভাইরাসের কারণে এখনো আতঙ্কিত পুরো বিশ্ব। যদিও এখন সারা বিশ্বেই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমছে। কমতে শুরু করলেও সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব মানুষের জীবনযাত্রায়। গত বছর সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর থেকে বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনাভাইরাস সবকিছুকে প্রায় এলোমেলো করে দিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ব অর্থনীতিকে। করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে অধিকাংশ দেশে দেওয়া হয়েছিল লগডাউন। এখনো অনেক দেশ রয়েছে লকডাউনের মধ্যে। যার বিরূপ প্রভাব এখন দৃশ্যমান। লগডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে এখন শুধু আমাদের দেশের অর্থনীতি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব অর্থনীতিও। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বে পড়ছে সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। কেননা, দ্বিতীয় ঢেউয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রথম দফায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা তেমন আশঙ্কাজনক না হলেও দ্বিতীয় দফায় যা ছিল শঙ্কার। এমন শঙ্কা কাটিয়ে অবশ্য দেশের মানুষ অনেকটা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। এখনো সেই ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে সামিল সবাই, যার যার জায়গা থেকে। অবশ্য এমন লড়াইয়ে, লড়াই করতে হবে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত।
এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। গত বছর করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ধাপে ধাপে চলেছে সরকার ঘোষিত লকডাউন। লকডাউনের মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকার প্রশ্নে বাসার বাইরে বের হয়েছেন। তারপরও করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এ কারণে, প্রতিটি দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর। বিশ্ব অর্থনীতি চলমান থাকে রপ্তানিমুখী আয়ের ওপর নির্ভর করে। আবার পাশাপাশি রপ্তানিও নির্ভর করে আমদানির ওপর। বিশ্বের প্রায় সব দেশ আগের মতো আমদানি ও রপ্তানি ঠিকমতো করতে না পারায় এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এখন করোনার ঢেউ যত লম্বা হবে নেতিবাচক প্রভাবও দীর্ষস্থায়ী হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশার খবর হলো বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমছে। তবে এটাও সত্য করোনাভাইরাসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে শেয়ারবাজার, পর্যটনশিল্প ও তেলের বাজারসহ প্রায় সবকিছুতে। এ ভাইরাসের বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এর ফলে অবশ্য উন্নত দেশগুলো শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কিন্তু নয়, করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন। কারণ উন্নত এসব দেশগুলোতে করোনার বিরূপ প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই এর আঁচ লাগছে অন্যান্য দেশের মধ্যেও। ইতোমধ্যে দেড় বছরের বেশি সময়ের পথচলায় যা দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সামনে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এর পেছনেও রয়েছে অনেক কারণ। প্রথমত, এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সবার জন্যই চ্যালেঞ্জের। তবে বাংলাদেশ সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শুরু থেকে কাজ করছে। সরকার এখন পর্যন্ত সঠিকভাবেই করোনা মোকাবেলা করে যাচ্ছে।
অবশ্য করোনার সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় লড়াইয়ে সামিল হয়েছে সবাই। করোনাভাইরাসের কারণে বিরূপ প্রভাবের কিছু উদাহরণ সামনে এসেছে। তবে এখানে শঙ্কার জায়গাটা অন্য জায়গায়। কারণ কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না করোনাভাইরাস থেকে কবে নাগাদ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মুক্তি পাবে। দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাস নির্মূল হলে হয়তো অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব পড়ত না। তবে করোনাভাইরাস যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে তাই এর বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে পড়ছে। অবশ্য ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর বাইরে নয়, বাংলাদেশও। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার সফলভাবে করোনা মোকাবেলা করে যাচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় নানা উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। তবে এখানে আমাদের জন্য কিছু শঙ্কার জায়গাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় শঙ্কার জায়গাটা হলো রপ্তানিপণ্য উৎপাদন যদি হ্রাস পায় তবে আমদানির পরিমাণও কমে আসবে। ঠিক তাই হচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। ইতোমধ্যে সব কল-কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক হয়ে শ্রমিকরা কাজ করছে। এর অর্থ হলো অর্থনীতিকে যতটা সম্ভব গতিশীল রাখা। এখন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যার যার জায়গা থেকে সহযোগিতা করতে হবে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সতর্ক হয়ে চলতে হবে। যারা জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে বের হবেন তারা যেন অবশ্যই মাস্ক পরে বের হন। বিশেষ করে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। করোনার মধ্যে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে এমন উদ্যোগ স্বাভাবিক। তবে এর মধ্যেই যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক কর্মকা- গতিশীল রাখতে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। সবার আগে নিজেদের বাজার স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে সরকার, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণকে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ এখানে সবার যার যার অবস্থানে থেকে কাজ করার যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। তবে তা করতে হবে অবশ্যই সচেতনভাবে। কারণ অর্থনীতি যদি ঠিকমতো গতিশীল না থাকে তবে বিরূপ প্রভাব পড়বে সবক্ষেত্রে।
করোনায় শুধু একটি দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তা নয়- বিরূপ প্রভাবের শিকার প্রায় প্রতিটি দেশ। সারা বিশ্বের জন্য অর্থনীতি সংক্রান্ত যে কোনো নেতিবাচক পূর্বাভাসই সব সময় ভাবনার। যখন সারা বিশ্বে এক সঙ্গে এমন ভাবনা শুরু হয় তখন তা সত্যিই শঙ্কা জাগায়। সেই শঙ্কার মধ্যেই রয়েছে বিশ্ববাসী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন বিশ্ববাসীকে ঘরে থেকে লড়াই করতে হচ্ছে একটি অদৃশ্য ক্ষুদ্র ভাইরাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু কিছুদিন পর সবাইকে লড়াই করতে হবে ঘর থেকে বের হয়ে। সেই লড়াই এখনকার মতো বেঁচে থাকার জন্য। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে সবাই ঘরের মধ্যে একপ্রকার বন্দি থেকে কোটি কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট করেছে। সেই কর্মঘণ্টা করোনা পরবর্তী সময়ে বেশি করে কাজে লাগিয়ে পোষাতে হবে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যেন করোনা তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে সে বিষয়েও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কাজ করতে হবে একসঙ্গে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে একে অন্যের প্রতি। বিশেষ করে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পাশে দাঁড়াতে হবে সবার আগে।
তবেই করোনার বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারব বিশ্ব। আবারও চাঙ্গা হবে বিশ্ব অর্থনীতি। আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।
সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক