করোনা মহামারির মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছেন বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা। এ তালিকায় শীর্ষে এখন বাংলাদেশ। শুধু ইউরোপ নয়, মহামারির মধ্যেও শ্রম অভিবাসনের নামে মানব পাচার কিংবা ভারতে নারী-কিশোরী পাচার কোনোটাই থেমে নেই। বরং এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে।
দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপমুখী হওয়ার এই প্রবণতা দারুণ উদ্বেগের। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং সেখান থেকে দুস্তর মরুপথ পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগর তীর থেকে নৌকাজাতীয় জলযানে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপে পাড়ি জমানোর চেষ্টায় ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন শত শত যুবক। হতভাগ্য যুবকদের একাংশকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে।
মানবপাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যার নাম। বিশ্বের গরিব দেশগুলো এ সমস্যার নিত্যকার শিকার। মানব পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে এ দেশের শত শত শিশু একসময় মধ্যপ্রাচ্যে উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় জকি হতে বাধ্য হয়েছে। এদের কেউ কেউ দৌড় প্রতিযোগিতার সময় আতঙ্কে প্রাণ হারিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, লেবানন, কাতার, জর্ডান, থাইল্যান্ড, ওমান, কুয়েত, লিবিয়া, বাহরাইনসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে যারা পাচার হন, তার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ নারী এবং ১৫ শতাংশ শিশু।
সারাদেশে মানব পাচারের ঘটনায় প্রায় ছয় হাজার মামলা বিচারাধীন। এগুলোর বিচার চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। ২০১২ সালে জারি হওয়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হলেও দীর্ঘদিন তা গঠন না হওয়ায় মামলার বিচারে জট তৈরি হয়েছে। আলাদা মানব পাচার প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর সেখানে এসব মামলার বিচার চলবে। বর্তমানে সিআইডির কাছে মানব পাচারের ৩০০ মামলা তদন্তাধীন। মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে এ অপরাধে মৃত্যুদ- থেকে সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদ- দেওয়ার বিধান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে রাখা হয়েছে। যার অর্থ, মানব পাচারের যে ন্যূনতম নূন্যতম মানদ- সেটা বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারেনি। এই মানদ-ে দীর্ঘদিন থাকলে অনেক দেশ বাংলাদেশি নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর হবে।
আমাদের দেশে মূলত একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলে তারপর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলে আলোচনা, সমালোচনা, নীতিনির্ধারকদের টকশো এবং সুশীলদের পরামর্শ। কিন্তু কিছুদিন পরে আরো একটি ঘটনার চাপে ঢাকা পড়ে যায় পূর্ববর্তী ঘটনা। আর এভাবেই অপরাধীরা আইনের থেকে পার পেয়ে যায়। মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারে বিলম্ব না করে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাচারকারীদের আটক করতে অভিনব কৌশল অবলম্বন করতে হবে। মানব পাচারের আরো একটি কারণ হলো অসচেতনতা। পাচার হওয়া ভিক্টিম যারা ফিরে আসে তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা ভিক্টিমদের বক্তব্য, তাদের দুর্দশার কথাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের মাঝে তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। যে এলাকা থেকে মানব পাচার বেশি হচ্ছে সেই এলাকা চিহ্নিত করে সচেতন করা। বেকারত্ব কমাতে যুবক ও মহিলাদের কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধি করে নিজ দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উন্নত দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। এ ছাড়া উপকূল ও সীমান্ত এলাকাতে পর্যাপ্ত কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। মানব পাচারকারী চক্রকে ভেঙে দিতে রিসিভিং কান্ট্রির অনেক ভূমিকা পালন করতে হবে। এই বিষয়ে সরকারের আরো বেশি সচেতন হওয়া এবং সুনজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়া জল, স্থল ও আকাশ পথে নজরদারি বাড়াতে হবে। ২১ শতক, সভ্য এক ধরণীতে দাস প্রথা বড়ই বেমানান। মানব পাচার জঘন্যতম একটি ব্যবসা। সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুবেÑএটাই প্রত্যাশা।