প্রচলিত প্রবাদ আছে-- ‘গরিব মানুষ পেয়ে/ গঙ্গা আসে ধেয়ে।’ অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের ওপর সবাই খড়্গহস্ত হয়। প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্যসৃষ্ট যে কোনো দুর্যোগে দরিদ্র মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা তুলনামূলক বিত্তবান এবং দৃঢ় আর্থিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারা দুর্যোগে ক্ষতির শিকার হয় তুলনামূলকভাবে কম। আর দুর্যোগে পতিত হলেও তাদের সেই প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা থাকে বেশি। আর আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে স্বাধীন এবং বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও সংকুচিত হয়ে পড়ে। এটা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সমভাবে বাস্তব। আমরা যাদের উন্নয়ন সহযোগী বলে মনে করি, তারা বেশির ভাগ সময়ই দরিদ্র দেশের প্রতি বিরূপ আচরণ করে থাকে। একই ইস্যুতে উন্নত এবং অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ হয় ভিন্নতর। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো বিত্তবান দেশের ওপর সাধারণত কর্তৃত্ব ফলাতে যায় না। কারণ, এতে তাদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আসলে তারা বিত্তবান দেশের স্বার্থই সংরক্ষণ করে থাকে। দরিদ্র দেশগুলো যেহেতু তাদের আর্থিক সহায়তার ওপরই নির্ভরশীল, তাই না চাইলেও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তিকর শর্তও মেনে নিতে বাধ্য হয়।
উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক সহায়তা পাওয়ার শর্ত হিসেবে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে দুর্নীতি হতো কি হতো না, তা নিয়ে এখন আর প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশ যদি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা না দিত তাহলে বিশ্বব্যাংকের যে কোনো কঠিন শর্ত মেনে নিয়েই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশের যেহেতু নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সক্ষমতা আছে, তাই বিশ্বব্যাংকের কোনো শর্ত সরকার মেনে নেয়নি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক সহায়তা ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেন এবং ভবিষ্যতে যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের আশ্বাস দেন। এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশ এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ফলে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেমন দরিদ্র দেশগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যায় ভোগে, ব্যক্তি পর্যায়েও ঠিক তা-ই। ব্যক্তি যদি দরিদ্র হন তাহলে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে খুবই কম। বিত্তবানগণ দরিদ্র মানুষের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত খুব সহজেই চাপিয়ে দিতে পারেন।
১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, তার পেছনেও একশ্রেণির বিত্তবান-ক্ষমতাশালী মানুষের স্বার্থপরতা কাজ করেছিল। সেই সময় দেশে খাদ্যাভাব ছিল ঠিকই কিন্তু তাই বলে এত বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হওয়ার মতো খাদ্যাভাব ছিল না। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একশ্রেণির স্বার্থপর মানুষ বাজার থেকে খাদ্য সরিয়ে ফেলে। ফলে বাজারে কৃত্রিম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। একশ্রেণির রাজনীতিবিদ তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশের খাদ্যশস্য পাচার করে দেয়। ফুড সাপ্লাই চেইন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ চরম খাদ্যাভাবে পতিত হয়। তারা রাস্তার ধারে কচু-ঘেঁচু কুড়িয়ে তা খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে। সেই সময় যদি খাদ্য সাপ্লাই চেইন ঠিকমতো কাজ করত, তাহলে দুর্ভিক্ষ অন্তত এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করত না। সেই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আনি আর চাটার দল খেয়ে ফেলে।’
বর্তমানে সারা বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব চলছে। এই করোনাকালীন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দরিদ্র মানুষ। তারা সুচিকিৎসা না পেয়ে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে। দুর্যোগের কারণে অনেকেই কর্মচ্যুত হয়েছে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এই দুর্যোগ আবার কিছু বিবেকহীন বিত্তবানের জন্য অর্থ কামানোর চমৎকার পন্থা হিসেবে উঠে এসেছে। তারা করোনার চিকিৎসা বা পরীক্ষার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আসলে মানুষের আর্থিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পারচেজিং পাওয়ার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। উন্নয়নের সুফল যাতে সবাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারে এজন্য সরকারকে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।