বৃটিশ কোম্পানিতে আব্বার চাকরীর সুবাদে চট্টগ্রামেই ছিল আমাদের বসবাস। বছরে একবার ধান তোলার মওসুমে আম্মা গ্রামে যেতেন। প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক আমার আব্বা আম্মা। ধান শুকিয়ে রাখত গ্রামের বিশ্বস্ত বেতনভুক্ত কিছু ব্যক্তি। তারাই সব করত। ধান শুকিয়ে চাল ভাঙ্গিয়ে রাখত। চালের গুঁড়িও তৈরি করে রাখত। আম্মা গ্রামে যেতেন। আতপ চালের ভাত আব্বা পছন্দ করতেন না। তিনি নিজের জমির ধান চালের ভাত খেতে পছন্দ করতেন। অনেক সময় গ্রাম থেকে শীতের পিঠা খেজুর রসের পায়েস বানিয়ে নিয়ে আসত গ্রামের আত্মীয়রা। তিরানব্বই সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আব্বা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আমার দুইভাই তখন আমেরিকা প্রবাসী। আব্বা আম্মাকে আমেরিকা নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা ভাইরা করে ফেলেছেন। তাঁদের ভিজিট ভিসাও হয়ে গিয়েছিল। মুল বিষয়ে আলোকপাত করি। তখন আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রামের মোগলটুলিতে। ময়না আপার সাথে আমাদের পরিচয় হয়। ওঁর পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের সখ্যতা বাড়তে লাগল। ময়না আপারা তিনবোন দুই ভাই। বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে ময়না আপার। শুনলাম কালো বেঁটে বলে তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসত না। ময়না আপার ছোট দুইবোন শাকেরা ও পাখি। শাকেরা আপা আমার চাইতে চার বছরের সিনিয়র ছিল। বড়বোন ময়নার বিপরীত। দুধে আলতা গায়ের রঙ কোমরে নেমে যাওয়া ঘন কেশরাশি স্লিম ফিগার -- এক কথায় পরিপূর্ণ সুন্দরী যুবতী। শাকেরা আপার মা মোটা দেহের অধিকারী। লম্বায় ছিলেন ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। হিন্দু ছিলেন তিনি। সত্তরের দশকে প্রেম করে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হন। দাম্পত্য জীবনে অসম্ভব সুখী ছিলেন তারা। ফার্নিচারের ব্যবসা ছিল তাদের। ময়না আপার পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বেড়ে চলল। অবস্থা এমন হল যে, বাসায় পোলাও বিরিয়ানি রান্না হলেই খালাম্মা ফোন দিতেন আমাদের বাসায়। খেতে ডাকতেন আমাদেরকে। আমাদের বাসায়ও তারা খেতে আসতেন। খালাম্মা বেশ মুডি ছিলেন। সহজে হাসতেন না। কিন্তু মনে অনেক মায়া মমতা ছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় রিভলভিং চেয়ারে বসে থাকতেন। গান শুনতেন টিভি দেখতেন পাশে থাকত টেলিফোন। কেউ রিং করলে আগে খালাম্মা ফোন রিসিভ করতেন। তারপর যার জন্য ফোন আসত, তাকে ডাকা হত। ছেলের বউ ছিল টুকটুকে সুন্দরী। বাংলা সিনেমার নায়িকা কাজরীর মত ছিল ভাবীর চেহারা। কোনবেলা কি রান্না হবে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করত। শাশুড়ি যা যা মেন্যু বলতেন তার একবিন্দু বাইরে যাওয়ার দুঃসাহস পুত্রবধূর ছিল না। পুরো বাড়ির রাজরানী ছিলেন ময়না আপা শাকেরা আপার মা। তিনবোনের মধ্যে ছোটটির নাম ছিল পাখি। পাখি দেখতে যত না কম সুন্দর ছিল তার চাইতে বেশি সুন্দরের ভাব ধরে চলত। বেশ অহংকার করত। ময়না আপা সামাজিকভাবে আইবুড়ি। এই কথা হাসিমুখে নিজেই নিজেকে বলত ময়না। আমার খারাপ লাগত। ওই হাসি স্বতঃস্ফূর্ত হাসি ছিল না। চাপা যন্ত্রণার হাসি। গায়ক রবি চৌধুরী তাদের বাসায় আড্ডা দিতে আসত। তখন রবি চৌধুরীর খুব জনপ্রিয়তা। রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি যখন ঝরে রে তোমার কথা শুধু মনে পড়ে রে, ওগো পল্লীবালা তুমি দূরে যেও না, ছোট্টবেলার সে কথা হয়তবা ভুলে গেছ, ইত্যাদি সব গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। খালাম্মার চেহারায় হিন্দু হিন্দু একটা ছাপ ছিল। উনাকে প্রথম দেখে আমার মনে হিন্দু বিষয়ক কৌতূহল জেগেছিল। কিন্তু সত্যটি জানতে সময় লেগেছিল সাড়ে পাঁচ মাস। শুনেছি খালাম্মার ডাক নাম ছিল চন্দ্রা। ওঁর পায়ে লোশন চুলে তেল লাগিয়ে দিত কাজের বুয়া। কখনো ছেলের বউকেও কাজটা করতে দেখতাম। এই পরিবারের তিনি কন্যার সবচেয়ে সুন্দরী কন্যা শাকেরা আপার প্রেম ছিল শওকত নামের একজন ব্যবসায়ী যুবকের সাথে। শওকত ঢাকায় ব্যবসা করত। দুই সপ্তাহ পরপর প্রেমের টানে বিমানে চড়ে চিটাগাং আসত। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা সুদর্শন ধনবান যুবক শওকতের সাথে শাকেরা আপার প্রেম নিয়ে তার পরিবারের কোন আপত্তি ছিল না। এমনকি শওকতের পরিবার থেকে আপত্তি ছিল না। তার মা খুব ফ্যাশনদুরস্ত মহিলা। ঢাকা ভার্সিটি থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন মহিলা। আধুনিক মন মানসিকতা শওকতের পরিবারের। শাকেরা আপাদের পরিবারও তাই।
একদিন ময়না আপা বিয়ের কার্ড নিয়ে এল। শাকেরা - শওকতের বিয়ে। সবাই খুশি। শওকতের মত সুশিক্ষিত সুপ্রতিষ্ঠিত পাত্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। শওকত চিটাগাং এসে শাকেরা আপাকে মার্কেটে নিয়ে যেত। গাদা গাদা জিনিস কিনে দিত। শাকেরা আপার পরিবারের সবার জন্য কিনত। যে পাত্র বিয়ের আগে প্রেমিকা ও তার পরিবারের জন্য এত টাকা পয়সা খরচা করত, তার মন মানসিকতা নিয়ে গৌরব করত পাত্রীর পরিবার। এটাই স্বাভাবিক। শাকেরা আপার বিয়ের বিশাল লিস্ট তৈরি হল। এই লিস্ট বানানো হল খালাম্মার নির্দেশে। কাতান বেনারসি কাঞ্জিভরম জামদানী জর্জেট মিলিয়ে শাড়ি দিতে হবে ৫০ টি। সোনার গহনা বিশ ভরি। কনেপক্ষের ফর্দ দেখে বরপক্ষ দ্বিগুণ করে দিল উপহারের পরিমাণ। শাকেরা আপা - শওকতের বিয়ে হল খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে। খালাম্মাও তার স্ট্যাটাস বজায় রেখেছেন। তিনি মেয়েকে দিলেন ১৬ ভরি সোনার অলংকার। বিয়েতে ৪০০ লোক খাওয়ানো হল। ময়না আপা বলল, শাকেরা তোমাদেরকে ডাকছে। অর্থাৎ আমরা তিনবোন বড়ভাইসহ বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। ভেতরে গিয়ে দেখলাম বধূবেশে শাকেরা আপা সোফায় বসে আছে। চেনাই যাচ্ছিল না তাকে। মেহেদীবাগের লুসি বিউটি পার্লার থেকে বউ সাজানো হয়েছে। লুসি বিউটি পার্লারের মালিক প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ'র শাশুড়ি। মহিলা জাপানিজ। সালমানের স্ত্রী সামিরাকে খুব অপছন্দ করতাম বলে লুসি বিউটি পার্লারে যাওয়া ভাল লাগত না। কারণ আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে সামিরার ঘনিষ্ঠতা। যাইহোক, শাকেরা আপার পরনে দেখলাম লাল স্বর্ণকাতান মাথায় গর্জিয়াস বিয়ের ওড়না সোনার ভারি অলংকার। এমনিতেই শাকেরা আপা খুব সুন্দরী ছিল। তাকে বউ সাজে দেখতে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম আমরা। বেশি ভাল লেগেছে তার খোঁপা। খোঁপায় সোনার ক্লিপ। জড়ির টারসেলের সাথে ছিল রজনীগন্ধা গোলাপ। সিনেমার নায়িকার মত লাগছিল তাকে। আমরা ছবি তুললাম। শওকতের গায়ে মেরুন শেরওয়ানী পায়ে নাগরাই জুতা। গলায় দামী ওড়না। খুশি হলাম এই ভেবে শাকেরা আপার জীবনে একজন সুপুরুষ এসেছেন। বরের মা'কে দেখে অনেকেই চমকে গেল। অসম্ভব স্মার্ট মহিলা। মহিলার বেশভূষা সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছিল বরের মা নয়- বড়বোন। ময়না আপা খুশিখুশি হয়ে উড়তে লাগল। বলল, জানো? সবাই বলল আমাদের শাকেরা রাজকপালী। এমন স্বামী শাশুড়ি সে পেয়েছে। বনেদী পরিবারে তার বিয়ে হচ্ছে। বরের খালারাও খুব স্মার্ট। ময়না আপার পরিবার বরের পরিবার নিয়ে মাথা বেশি ঘামাচ্ছে মনে হল আমার।
বিমানে করে নববধূকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হল বিয়ের রাতে। উত্তরায় শওকতদের নিজস্ব বাসভবন। বিয়ের পর কয়েক বছর ভালই চলছিল। শাকেরা আপা প্রেগন্যান্ট হল। তাদের ঘরে একটা ছেলে জন্ম নিল। শওকতের ব্যবসা বাণিজ্যের আরও উন্নতি ঘটল। শাকেরা আপা বাচ্চা ঘর সংসার নিয়ে মহাব্যস্ত। এরপর আমরা মোগলটুলি এলাকা থেকে বাসা বদলে আগ্রাবাদ সিডিএতে চলে এসেছি। দীর্ঘদিন ময়না আপাদের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়নি। একদিন ঈদের বাজার করতে গিয়ে লাকি প্লাজায় ময়না আপার ভাবীর সাথে দেখা হল। যাকে দেখতে নায়িকা কাজরীর মত মনে হত। ভাবীকে সবার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। ছোটবোন পাখির বিয়ে হয়ে গেছে। শাকেরা আপা তার বাবা মায়ের সাথে ঈদ করতে আসবে। আমাদেরকে যেতে বলল। শাকেরা আপা নাকি তার ভাবীর কাছে জানতে চেয়েছিল আমাদের নতুন বাসার ঠিকানাটা যেন জেনে নেয়। সে আসবে আমাদের বাসায় দেখা করতে। খুব খুশি হয়ে ভাবীকে ঠিকানা ফোন নাম্বার দিলাম। কিন্তু ঈদে শাকেরা আপা এল না। পরে শুনেছি টাইট স্কেজুয়াল ছিল। শওকতের সাথে ঝগড়া করে চলে গেছে। দাম্পত্য জীবনে ঝগড়াঝাঁটি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। শাকেরা আপা চাপা স্বভাবের ছিল। বিয়ের বছর দুয়েক পর খুব চুপচাপ হয়ে গেছে -- তার পরিবার লক্ষ্য করল।
এরপর চট্টগ্রাম থেকে আমি ঢাকায় চলে গেলাম বছর দুয়েকের জন্য। চিটাগাং আমার ভাইবোনরা থাকে বলে প্রায়ই যাওয়া আসা হত। একদিন আগ্রাবাদের হাজিপাড়ায় ময়না আপাদের ফার্নিচার দোকানে ময়না আপাকে দেখে রিকশা থেকে নামলাম। ওমা চেহারার কি দুর্দশা হয়েছে তার! খুব বুড়িয়ে গেছে। বয়স যেন ৬০ হয়ে গেছে। শুনলাম শাকেরা আপা আর নাই। নাই মানে? আমি একরকম চেঁচিয়ে উঠলাম। ময়না কাঁদতে কাঁদতে বলল, শাকেরাকে তার স্বামী শাশুড়ি মেরে ফেলেছে। খুন করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে। শাকেরা আপার মৃত্যুর ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলাম না। এরমধ্যে নদীর জল বহু গড়িয়ে গেছে।খালাম্মা মারা গেছেন। পাখির তিন ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। খালু স্ত্রীশোকে আলাভোলা হয়ে আছেন বছর কয়েক ধরে। তার মেজোকন্যার মৃত্যুর খবর তাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া নেই পিতার। শিশুর মত তার অবস্থা। ময়না আপা বলেছিল ফ্যানে ঝুলন্ত শাকেরা আপার ছবি নাকি আছে। আমার ভেতরে অসহ্য এক যন্ত্রণা হল। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। বাসার ঠিকানা নিয়ে পরদিন বিকেলে ময়না আপাদের হালিশহরের বাসায় গেলাম। সোফায় বসলাম। দেয়ালে অনেকগুলো পারিবারিক ছবি। শাকেরা আপা আছে প্রায় সব ছবিতে। তরজাতা হাসিখুশি মুখ। স্লিম ফিগার বদলে গিয়ে মেদ জমেছে। তবে যেটুকু মেদ জমেছে এতে তাকে আরও বেশি রুপবতী লাগছিল। ঘরের চারদিকে চোখ বুলালাম। এই সোফা ডাইনিং টেবিল ডিভানে শাকেরা আপার স্পর্শ আছে। ময়না আপা একটা কাগজের প্যাকেট নিয়ে আমার পাশে বসল। প্যাকেট খুলতেই আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। আমি ক্রমশ জমে যাচ্ছিলাম। বেডরুমে ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে শাকেরা আপার প্রাণহীন দেহ। খয়েরি রঙের ওড়না দিয়ে তার গলা ফ্যানের সাথে বাঁধা। কিন্তু রহস্যজনক ব্যাপার হচ্ছে বিছানার সাথে তার পা প্রায় লেগে আছে। ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করলে বিছানায় পায়ের আঙুল স্পর্শ হবার কথা নয়। শাকেরা আপার দুই পায়ের তিন আঙুল করে ছয় আঙুলে রুপার রিং পরা। তার মানে কোনভাবে তাকে হত্যা করে ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে একটা কথা আছে অপরাধী যত নিখুঁতভাবে অপরাধ সম্পন্ন করুক না কেন, কোন না কোন প্রমাণ সে রেখে যায়। শাকেরা আপার বেলাতেও তাই হয়েছে। তার স্বামী শওকত পরনারীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হয়। তিক্ততা চরম পর্যায়ে রুপ নেয়। ওই নারীও ছিল এলিট শ্রেণির। অবৈধ সম্পর্কের দাবানলে পুড়ে যায় শাকেরা আপার সুখের দিনগুলি। স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শাকেরা আপা। কিন্তু সামাজিক স্ট্যাটাসের কারণে ভড়কে যায় শওকত ও তার মা। মা ছেলে প্ল্যান করে শাকেরাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। গলাটিপে খুন করে শাকেরা আপাকে। কারণ তার গলায় খামচি ও লাল লাল মোটা দাগ ছিল। ছবিতেও তার গলার ডানপাশে লাল দাগ দেখেছি। ময়না আপা বলল তার বোনের ফর্সা ঘাড়েও একই রকম দাগ দেখেছে তারা। মৃত্যুর সময় বেগুনি রঙের কামিজ পরনে ছিল তার। শওকতের পরিবারের ক্ষমতাবল প্রকট। সরকারি মহলে তাদের শেকড় আছে। সেই ক্ষমতার জোরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমূল বদলে দেয়া হল। হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হল। আজো আমি শাকেরা আপাকে স্মরণ করি। তার হাসির শব্দ তার গানের শব্দ কানে অবিরত বাজে। শাকেরা আপা যেন আমার স্বপ্নে দেখা এক অসমাপ্ত অধ্যায়।