বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর গত বছরের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত ২৩টি প্যাকেজের আওতায় দুই দফায় আড়াই লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
এর মধ্যে ঋণনির্ভর প্রণোদনাই প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা, অন্যান্য খাতের জন্য বরাদ্দ হয় বাকি টাকা। প্রণোদনার শর্ত অনুযায়ী, ঋণের টাকা শুধু চলতি মূলধন হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা তহবিল থেকে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ দেওয়া যাবে।
কিন্তু প্রণোদনার কোনো অর্থ দ্বারা আগের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। একইসঙ্গে কোনো খেলাপি গ্রাহককে ঋণ দেওয়া যাবে না। প্রণোদনার অর্থ স্বচ্ছভাবে ব্যবহার করতে হবে। ঋণের টাকা কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে, তা কঠোরভাবে তদারক করার নির্দেশনাও ছিল।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক ও প্রণোদনা গ্রহীতাদের একটি বড় অংশই এসব শর্ত মানেনি। প্রণোদনায় ঋণ নিয়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের জালিয়াতি করেছে। তারা শর্ত ভঙ্গ করে কম সুদে ঋণ নিয়ে বেশি সুদের ঋণ পরিশোধ করেছেন।
প্রণোদনার ঋণ মূল হিসাব থেকে ৪-৫ দফা স্থানান্তরের পর নগদ আকারে তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব অর্থ অন্যের নামে পে-অর্ডার করে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ খাতের অনেক অর্থ কোথায় কীভাবে নেওয়া হয়েছে, এরও কোনো হদিস মিলছে না। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাংকগুলোও সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের বেআইনি কর্মকা-ে সহায়তা দিয়েছে।
প্রণোদনার ঋণের অপব্যবহার হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য উঠে এলে তারা তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়, এ ছাড়া পরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সারা দেশে তদন্ত শুরু করে। এসব তদন্তেই উঠে এসেছে উপরোল্লিখিত তথ্যসমূহ।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল করোনায় অর্থনীতির যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে। প্রণোদনার অর্থ সঠিকভাবে প্রয়োগ হবে, এটাই কাম্য ছিল। কিন্তু দেখা গেল, বেশকিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান এই অর্থ নিয়ে জালিয়াতি করেছে।
এই অন্যায় ও দুর্নীতি ক্ষমার অযোগ্য। তবে শুধু গ্রাহক নয়, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোও তাদের যে সহযোগিতা করেছে, তা ঘোরতর দুর্নীতি। যেসব গ্রাহক প্রণোদনার ঋণ নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করেছেন, তাদেরকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা বেআইনিভাবে সহযোগিতা করেছেন।
ব্যাংকাররা চেয়েছেন, যেভাবেই হোক আগের ঋণ পরিশোধের সুযোগ করে দিতে হবে। এতে তারা ব্যাংক ঋণ আদায় দেখাতে পারবে। এ লক্ষ্যে অনেক ব্যাংক গ্রাহকের প্রণোদনার অর্থ নগদ আকারে তুলে নিয়ে আগের ঋণ শোধের পথ দেখিয়েছে।
প্রণোদনার অর্থ নিয়ে যারা জালিয়াতি করেছেন তারা শুধু নন, যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা এই জালিয়াতিতে সহযোগিতা করেছেন, সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। শর্ত ভঙ্গ করা শুধু অন্যায়ই নয়, দুর্নীতিও বটে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক পুরো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে এটাই প্রত্যাশা।