বাবার সাথে তেমন আলাপ হয়নি। কথা ভালমত শেখার আগেই বাবার খুব জরুরী কাজ তিনি হুড়োহুড়ি চলে গেলেন। এতে করে হলো কি, তিনি আমার তিন বছর বয়সেই আটকে রইলেন। তার আর বয়স বাড়েনি।
তাড়াহুড়ায় আমার জন্য এক হারমনিয়াম ছাড়া আর কিছুই বাবা রেখে যাননি। না কোন ঘর, না জমানো স্বপ্ন, কুঁচি দেয়া ফ্রক, সম্পর্ক, কিচ্ছু না। ফলে একা সত্যিকার সংগ্রামে পড়লাম। সত্যিকার মানুষ দু'চোখে চিনলাম। কারা কেন ভাল ছিলেন, কারা কেন আর খোঁজ নেন না, একটু একটু করে বুঝতাম তখন। জীবন তুমি কত কিছু নিয়ে গেলে গো,কোনো কিছুই না দিয়ে।
সরল অঙ্ক করতে করতে বাবাকে চাইতাম। আমার সব সরল মিলতো ,আইনের গরল মিলতোনা। বাবাকে যে এনে দিতে পারে তাকে মুখে মুখে সমস্ত টাকা পয়সা দিয়ে দিতাম। আমার একটা মাটির হাতিব্যংকে শব্দ করা টাকা থাকতো। কিন্তু কেউ আর তাকে এনে দিতে পারেনি বিধায় আমার টাকারা বাড়তেই থাকলো। আমি তৃপ্ত ভঙ্গীতে দিন কাটাই। আরো আরো টাকা হোক। বাবাকে যে সত্যি সত্যি এনে দেবে সব টাকা তাকেই দিয়ে দেবো।
এই দেয়া নিয়ে এক গল্প আছে।মা'র মুখে শোনা।বাবা তখন বেঁচেআছেন দিব্যি।আমি আড়াই বছরের। জামা জুতো পরে বেড়াতে যাবার সময় গেটের বাইরে দেখি,আমারই বয়সী এক বাচ্চামেয়ে হাত পেতে ভিক্ষা করছে। তার গায়ে কোন ফ্রক নেই। ফ্রক নেই কেন ! .
.আমি নিজের গায়ের ফ্রকটাই খুলে দেবার চেষ্টা করছিলাম। বাবা দৌড়ে এসে আমার জামা লাগিয়ে দিলেন। ঘর থেকে আমারই আরেকটা জামা বাচ্চাটিকে দিলেন,তবে আমার মন শান্ত হলো। আমার কথা ছিলো ' ওর গায়ে জামা নেই কেন বাবু'? (বাবাকে বাবু বলতাম )।বাবা হেসে মা'কে বলতেন ''তোমার মেয়ে দেখো সবাই কে সব কিছু দিয়ে দেবে। নিজের কিছুই রাখবে না।'' কত্ত পুরোনো কথা। আসলে তাকে ঘিরেই আমার যত পুরোনো ঘ্রাণ, মরচে পড়া সিন্দুক খুলে বার বার উঁকি দেয়।
বাবা রোজ লেখালেখির পর, গানের সুর করার সময় আমাকে কোলে নিয়ে বসতেন। কিন্তু তখন আমি খেলতে যাবো। আর বাবা চেপে ধরে রাখবেন, রাখবেনই। তার পর চলবে গান শেখানো।কঠিন কঠিন সব গান।
বাবা শেখাচ্ছে...' বলো বাবা জনতার সংগ্রাম চলবেই''।
''জনতা সংগাম চলবেই। '' (আমি ভাল করে বলতে পারিনা)
''আমাদের সংগ্রাম চলবেই '
''আমাদের সংগাম চলবেইইইইই।'' মানে আবেগের চোটে অনেকগুলো ই'। তাই দিয়ে বাবার সাথে তারস্বরে গলা মিলানো। আর ছিলো ''খরবায়ূ বয় বেগে ''গানটা। বাবা খুব জোরে হাইয়্যো টান দিতেন আর আমি খুব ঘাড় কাৎ করে 'হাইয়ো হাইয়ো' করতে করতে হেসেই মরতাম।
আর সারাদিন বাবা মেয়ে কুটকুট করে গল্প " বাবা ,নানু বাড়ি যাও না কেন? (আসলে নানুবাড়ি পাশেই।সারাদিন নানুবাড়ি যাই। )
''ধোঁ য়া ... মশাআআআআ'' আমি মুখ কুঁচকে বলতাম।
কাহিনী হচ্ছে নানুবাড়ির উঠোনে প্রচুর গাছ,তাই মশা তাড়ানোর জন্য সন্ধ্যা বেলায় শুকনোপাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া দেয়া হতো। তো তখন খুব চোখ চুলকিয়ে কান্না পেত। অথচ সারাদিন লক্ষ্যবার নানুবাড়ি তিড়িং বিড়িং যাচ্ছি ,খাচ্ছি কোন অসুবিধা নেই।
বাবা মজা করে বলতেন ''আরো যাবে নানু বাড়ি ''?
'যাবো না বাবা, নানুবাসায় ধোঁয়া মশাআআআআ'' .... হেসে আমি বাবার গলা ধরে ঝুলতাম।
আহা এইসব আনন্দ-কথা একটা ক্যাসেটে বন্দী ছিলো। তাঁর আর মেয়ের কন্ঠস্বর।এই দূর্লভ ক্যাসেটটা এখন নেই। বাবা এখনও সেই তিন বছরের মেয়ের বুকের ভেতর বন্দী।
যাবো বললেই কি যাওয়া যায়? যায় না......তাই না বাবা?