জাতীয় সম্পদ টাঙ্গুয়ার হাওরকে ধ্বংশপ্রাপ্ত অবস্থা থেকে পূনরুদ্ধার করে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রকৃত-পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র উন্নয়নে স্থায়ী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবিতে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এ স্মারকিলিপি প্রদান করা হয়।
বৃহস্পতিবার সকালে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের পক্ষে স্বারকলিপি গ্রহণ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব বিজন কুমার সিংহ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক একে কুদরত পাশা, প্রচার সম্পাদক আনোয়ারুল হক প্রমূখ।
জাতীয় সম্পদ টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র পূনরুদ্ধারে হাওর বাঁচাও আন্দোলন প্রধানমন্ত্রীকে শেষ ভরসা মনে করে। তাই টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় স্থানীয় জনমতের প্রতিফলন অনুযায়ী তারা সাতদফা দাবি উত্তাপন করেন। সাতদফায় রয়েছে, টাঙ্গুয়ার হাওরের বর্তমান ব্যবস্থাপনা বাতিল করতে হবে। টাঙ্গুয়ার র হাওর ব্যবস্থাপনার নামে বিগত ২০ বছরের কার্যক্রমের ব্যয়ের স্বচ্ছতা এবং এতে দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত করতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনা শুরুর প্রারম্ভে গাছ, মাছ, পাখি, সরীসৃপ, পোকামাকড় ও অন্যান্য প্রাণী তথা সামগ্রিক জীববৈচিত্রের প্রজাতি ও সংখ্যা এবং বর্তমানে বিদ্যমান প্রজাতি ও সংখ্যার তারমধ্য মুল্যায়ন করতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র ফিরিয়ে আনতে অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ৫ বছরের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ও পাখি ধরা এবং বনজ সম্পদ আহোরণ বন্ধ করতে হবে। হাওরের জনসাধারণ ও পর্যটকের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মৎস্য, বন, প্রাণীসম্পদ তথা সামগ্রিক জীববৈচিত্র রক্ষায় এবং পরিবেশ বান্ধব পর্যটন নিশ্চিতকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আইন প্রনয়ন করে “টাঙ্গুয়ার হাওর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ” গঠন করতে হবে। “টাঙ্গুয়ার হাওর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ” গঠনের পূর্বে অন্তর্বতীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কোস্টগার্ড, বিজিবি ও পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে।
স্মারক লিপিতে তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার সুদক্ষ নেত্রীতে দেশের উন্নয়নের মহাসড়কে হাওর বাসীকে যুক্ত করায় আমরা কৃতজ্ঞ। আপনার নেত্রীত্বে দেশ এগিয়ে যাবে আমরা বিশ্বাস করি এবং হাওর এলাকার মানুষ সে উন্নয়নের অংশীদার হবে সেটা আমরা আশা করি। আপনি নিশ্চই অবগত আছেন, দেশের উত্তর-পূর্বঞ্চলে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলায় প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান, প্রথমটি সুন্দরবন।
টাঙ্গুয়ার হাওর মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে মিশেছে এই হাওরে। তিন উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্রের আঁধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইসিইউএন এই হাওরের জীববৈচিত্র রক্ষায় কাজ করেছে। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। সুইস অ্যাজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) এবং আইসিইউএন ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ‘টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প পরিচালনা করেছে। বর্তমানে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকলেও মাঠ পর্যায়ে কোন কার্যক্রম নেই।
আপনি জেনে বিস্মিত হবেন, এনজিও সমুহ কর্তৃক টাঙ্গুয়ার হাওর বিষয়ক যে সব গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তার সাথে বাস্থবের কোন মিল নেই। ২০০০ সালের পূর্বে দৃশ্যমান বাস্তবতা ছিল টাঙ্গুয়ার হাওর প্রকৃত অর্থেই গাছ, মাছ, পাখি, সরীসৃপ, পোকা-মাকড় সমৃদ্ধ অনন্য বৈশিষ্টের এক জীব বৈচিত্রের আধার। বর্তমানে দৃশ্যমান বাস্তবতা টাঙ্গুয়ার হাওরে মূলত জীব বৈচিত্রের খুব একটা অবশিষ্ট নেই। ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েগেছে গাছ, মাছ, পাখি, সরীসৃপ, পোকা-মাকড়। মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংশ হয়ে গেছে। যে হিজল-করচগাছগুলো ছিলো তাও রাতের আঁধারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পর শুধু বিপুল জলরাশি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আবার উজানে প্রতিবেশী দেশে পাহাড় ধ্বসের কারণে প্রতি বর্ষায় বিপুল পরিমানে বালি-পাথর এসে টাঙ্গুয়ার হাওরের উত্তর এলাকা ভরাট হচ্ছে।
আপনি নিশ্চই অবগত আছেন ২০১৭ সালে হাওর বিপর্যয়ের সময় সুনামগঞ্জে ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ নামে একটি নাগরিক সংগঠন গড়ে উঠে। পরবর্তীতে হাওরাঞ্চলের কৃষকের দাবির প্রেক্ষিতে সংগঠনটি ‘হাওর বাচাও আন্দোলন’ নামে হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলায় বিস্তৃত হয়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হাওর এলাকার কৃষি ও কৃষকের তথা গণমানুষের যৌক্তিক দাবি নিয়ে কাজ করে আসছে।