দেশের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়ায় কমে আসছে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের পরিমাণ। অথচ একটা সময় মূল উন্নয়ন বাজেটের বেশির ভাগই ছিল বৈদেশিক ঋণ বা অনুদাননির্ভর। আর তখন উন্নয়ন সহযোগীদের নানারকম প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ মানা ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কারণ দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে। একই সাথে সঙ্গে বাড়ছে সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতাও। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যানুযায়ী প্রকল্প বাসবতবায়নে বৈদেশিক নির্ভরতা দিন দিন হ্রাস পেয়েছে। আর এ প্রবণতা অভ্যন্তরীণ সম্পদের শক্তিশালী অবস্থানই চিহ্নিত করে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুটি উৎস হতে অর্থায়নের জোগান দেয়া হয়। তার একটি অভ্যন্তরীণ, অন্যটি প্রকল্প সাহায্য হিসাবে প্রাপ্ত ঋণ বা অনুদান (খাদ্য সহায়তা, বাজেট সহায়তা, পণ্য সহায়তা, বিশেষ উন্নয়ন সহায়তা, ঋণ বা পলিসি ঋণ)। কিন্তু ধীরে ধীরে বৈদেশিক ঋণ বা সহায়তা কমে আসছে। বিগত বছরগুলোয় ধারাবাহিকভাবে এমন অবস্থা দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক বছরের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। তার মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা বা ৬৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর বৈদেশিক অর্থায়ন ধরা হয় ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যা ৩০ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের আরএডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ধরা হয় ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা বা ৬৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। বœ বৈদেশিক সহায়তা থেকে বরাদ্দ ছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা বা ৩০ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আরএডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা বা ৭১ দশমিক ১২ শতাংশ। বœ বৈদেশিক অর্থায়ন ছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা, যা ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তাছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিলের ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বা ৬৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ ছিল ৫২ হাজার ৫০ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আরএডিপি বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৮৩ হাজার ৪৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বা ৬৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বৈদেশিক অর্থায়ন ছিল ৩৫ হাজার ৭৯৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা বা ৩৩ দশমিক ০১ শতাংশ।
সূত্র জানায়, একটা সময় ছিল যখন বাজেট বাস্তবায়নে বৈদেশিক অর্থায়ন না পেলে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলেও তা নেয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন ওই অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। এখন বৈদেশিক ঋণ ছাড়াই নিজেদের অর্থে প্রকল্প নেয়ার সক্ষমতা অর্জন হয়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক, কিন্তু তাই বলে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন নেই তা বলা যাবে না। কেননা বিদেশি ঋণের প্রকল্প হলে ভালো সংস্থাগুলো তদারকিও করে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে একটা জবাবদিহি রক্ষা হয়। তাছাড়া সরকার যদি উন্নয়ন কর্মকা-ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই সব ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে ব্যক্তি খাত ঋণ পাবে না। তাই সেটাকে অতিসরলীকরণ করা যাবে না।
সূত্র আরো জানায়, বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি দেশীয় সক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। এখন দেশীয় অর্থেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়ছে। সেক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ সরকারের নিজস্ব টাকায় আমাদের টাকায় করা হচ্ছে। একসময় ওই ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা চিন্তাই করা যেত না। তাছাড়া যতো বেশি বৈদেশিক ঋুনির্ভরতা কমবে, ততোই ভালো। কেননা ওই ঋণ সুদসহ ডলারে পরিশোধ করতে হয়। ফলে রিপেমেন্টে (পরিশোধ) যদি কম করতে হয়, তখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। যা ইতিবাচক। এটাকে আমি ইতিবাচক দেখছি।
এদিকে এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম জানান, পলিসিই হচ্ছে দিনে দিনে বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা। সেক্ষেত্রে দেশে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু দেশীয় অর্থায়নের বরাদ্দ বাড়াটাই স্বাভাবিক। এখন দেশের দর কষাকষির সামর্থ্য বেড়েছে। আগে তো কথাই বলা যেত না। সহজ শর্তে যেসব উৎস থেকে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার কথা, এখন সেগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারের প্রয়োজন একটা ভারসাম্য পরিস্থিতি তৈরি করা। কেননা পুরো উন্নয়ন বাজেটই যদি দেশীয় অর্থে করা হয় তাহলে তা খুব বেশি ভালো দিক নয়। কিছু বৈদেশিক অর্থায়ন থাকতেই হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে যে পরিমাণ বৈদেশিক অর্থায়ন দরকার তা পাওয়া জরুরি। তাছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদের হারও কম। সেক্ষেত্রে যা জরুরি, তা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করতে হবে।