জামালের নাম কখন কীভাবে মাকরু হলো সেটা কেউ জানে না। জামালকে সবাই এখন মাকরু নামেই ডাকে। প্রথম প্রথম জামাল মাকরু ডাকে সাড়া দিতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে নিজেও এই নাম হজম করে ফেললো। এভাবে মাকরুর প্রবল দাপটে জামাল নামটা একসময় হারিয়ে গেল। মাকরুর যে একটা পৈতৃক নাম আছে সেটা যেন সবাই ভুলে গেল। তবে তিনজন মানুষ জামালকে এখনো জামাল নামেই ডাকে। এই তিনজন মানুষের প্রথমজন হলো জামালের মা মনোয়ারা বেগম, দ্বিতীয়জন জামালের বাবা ইসমাইল হোসেন এবং তৃতীয়জন হলো জামালের মার্বেল খেলার সাথী ইমন।
প্রত্যেকটা মানুষ মায়ের পেট থেকে বের হওয়ার সময় বিশেষ একটা মেধা নিয়ে বের হয়। এই মেধা সে জন্মের পর চর্চা করে অর্জন করে না বরং চর্চার মাধ্যমে সেটাকে আরও ধারালো করে তোলে। ইমনের এমন একটা সহজাত মেধা হচ্ছে মার্বেল খেলা। শুধু মার্বেল খেলা বললে ভুল হবে ফুটবল, ক্রিকেট, ক্যারম সব খেলায় সে সমান পারদর্শী। জন্মের পর থেকেই সে ভালো খেলছে। তবে ইমন মার্বেলেই খেলে। মার্বেল খেলতে সে সুখ পায়- বলতে গেলে মার্বেল খেলা তার নেশা। স্কুল ফাঁকি দিয়ে শিমুল গাছের তলায় সে মার্বেল খেলে সারাদিন। স্কুলব্যাগ অদূরে অসহায় হয়ে পড়ে থাকে গুল্মঝোপের নিচে। ঠিক স্কুল ছুটির সময় ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। মাঝে মাঝে তার এই স্কুল চুরি ধরা পড়ে। যেদিন ধরা পড়ে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় তার পিঠের ওপর ভারী শিলাবৃষ্টি ঝরে। পিঠের ওপর দিয়ে বৃষ্টি-ঝড় যতোই বয়ে যাক ইমন তার মার্বেল খেলা ছাড়ে না। সে অপরিবর্তিত, তবে প্রতিবার ধরা পড়ার পর মার্বেল খেলার জায়গা পরিবর্তিত হয়। সর্বশেষ সে শিমুলতলায় ধরা পড়েছে এক সপ্তাহ আগে। সেদিন মার্বেল খেলা চলছিল যথারীতি জামালের সাথে। হঠাৎ জামালের বাবা ইসমাইল হোসেন কোথা থেকে যেন আবির্ভূত হলেন চুপি চুপি। জামালকে ধরে ফেললেন খপ করে। এরপর টেনে নিয়ে গেলেন মারতে মারতে। ইমনকে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে গেলেন। ইমন নিজে একটা খারাপ ছেলে, পাড়ার অন্য ছেলেদেরও সে খারাপ করছে। পৃথিবীতে আর কি মার্বেল খেলার কেউ নেই। জামালকেই কেন ডাকাডাকি। এরপর থেকে সে যেন জামালকে আর তার সাথে মার্বেল খেলায় না ডাকে। ইসমাইল হোসেন শুধু এটুকুতেই ক্ষান্ত হলেন না, সন্ধ্যাবেলায় ইমনের বাবার কাছে গিয়ে নালিশ করলেন। ইমনের পিঠের ওপর দিয়ে এবার বড়সড় একটা টর্নেডো বয়ে গেল। টর্নেডোর আঘাতটা এখনো মোছেনি। জামালও ইমনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া টর্নেডোয় বেশ ব্যথিত। ব্যথার ফলস্বরূপ তারা দু'জনে এখন আরও মহা উদ্যমে মার্বেল খেলায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছে। ইমন মনে মনে ইসমাইল হোসেনকে একটা শাস্তি দেয়ার ফন্দি এঁটে ফেলেছে। ইসমাইল হোসেনের অতি প্রিয় একটা জিনিস আছে। সেই জিনিসটা চুরি করার ফন্দি। ফন্দিটা জামালের বেশ পছন্দ হয়েছে। কারণ তার বাবা ইসমাইল হোসেনের প্রিয় জিনিসটার প্রতি সে নিজেও ভয়ানক রুষ্ট। কাজেই চুরির ভারটা সেই নিলো। চুরিটা হবে আজই। জামাল অপেক্ষায় আছে। ইসমাইল হোসেনের বাড়ি থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা।
প্রতিদিন সকাল ঠিক ১০টার সময় ইসমাইল হোসেন দেড় পেল্গট ভাত খান। গরম ভাত। ঘড়িতে এখন সময় সকাল ১০টা। ইসমাইল হোসেন খাওয়ার টেবিলে বসেছেন। তার সামনে একটা সোনালি রঙের পেল্গট। পিতলের পেল্গট। এই পিতলের পেল্গটই হচ্ছে ইসমাইল হোসেনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। পেল্গটটা একান্তই তার। তিনি ছাড়া অন্য কেউ এই পেল্গটে হাত দিতে পারেন না। ইসমাইল হোসেন কাউকে হাত দিতে দেন না। এই পেল্গটটা একসময় তার দাদার দখলে ছিল। দাদা থেকে বাবার হাত ঘুরে এখন তার হাতে এসে পড়েছে। তার হাত থেকে একসময় এই পেল্গট যাবে জামালের হাতে। পরম্পরা। ইসমাইল হোসেনের দাদা শক্ত হাতে এই পরম্পরা শুরু করেছিলেন। পরম্পরা তখন থেকেই শক্ত হাতে চলে আসছে। ইসমাইল হোসেনের হাতে এসে বরং সেটা আরও শক্তিশালী হয়েছে। দিনে দিনে পিতল পেল্গটের মর্যাদা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। তবে ইসমাইল হোসেন তার এই পৈতৃক পিতল পেল্গটের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ সন্দিহান। জামাল যে এই পিতল পরম্পরার পায়ে কুড়াল মারবে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। ইতোমধ্যে ইসমাইল হোসেনের এই পেল্গটটা সে কয়েক বার গুম করার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু ইসমাইল হোসেনের অতি সতর্কতার কারণে শেষমেশ সে সফল হতে পারেনি। পিতল পেল্গট স্বমহিমায় টিকে আছে এখনও। ইসমাইল হোসেন পিতল পেল্গটে খাওয়া শেষেই সেটাকে তালাবদ্ধ করে রাখেন। ঠিক তার খাওয়ার সময় পিতল পেল্গট আবার বেরিয়ে আসে তালামুক্ত হয়ে।
ইসমাইল হোসেন খাওয়া শেষ করে ১১টার সময় ব্যাগ হাতে বের হলেন। পিতল পেল্গট তালাবদ্ধ করতে ভুললেন না। এই কাজটা শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত অবশ্য তিনি কোনোদিন ভোলেননি। বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি সোজা ইমনদের বাড়িতে এলেন। ইমন বাড়িতেই আছে। ইসমাইল হোসেনকে দেখে সে ভেতরে ভেতরে ভয় পেল ভীষণ। ইসমাইল হোসেন তো কখনো এই সময় তাদের বাড়িতে আসেন না। তাহলে কি জামাল ধরা পড়লো? ইমন শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
ইসমাইল হোসেন বাড়িতে ঢুকেই ইমনের খোঁজ করতে লাগলেন। ইমন অবস্থা বেগতিক দেখে বাহির দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল বাইরে। বাইরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকলো। ইসমাইল হোসেন চলে যাওয়ার পর আবার ফিরে এলো বাড়িতে। বাড়িতে বাবা নেই। কাজেই মাকে যদি ইসমাইল হোসেন কোনো নালিশ দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটাকে বাবার কানে যাওয়া থেকে বিরত করতে হবে। ইমন ভীরু পায়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইমনের মা হাসলেন। বললেন, কিরে কই লুকাইছিস? তোর নামে নালিশ করেননি। দ্যাখ তোকে কী দিয়ে গেছেন।
ইমন দেখলো ইসমাইল হোসেন তাকে শরৎচন্দ্রের দু' তিনটা বই- এর মধ্যে একটা বই আকারে বেশ বড়, অনেকগুলো চকলেট আর একটা ফুটবল দিয়ে গেছেন। ইমন জিনিসগুলো দেখেই বাড়ি থেকে ছুটে পালালো। ইমনের মা ইমনের এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাক হলেন। ইমন বাড়ি থেকে বের হয়েই সোজা শিমুলতলায় চলে এলো। শিমুলতলায় এসে দেখলো জামাল ইতোমধ্যে এসে হাজির। জামালের হাতে কোনো পেল্গট নেই। ইমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বললো, কিরে কখন এলি?
জামাল কখনের উত্তর না দিয়ে দাঁত বের করে বললো, 'পেল্গট পাওয়া গেছে।'
ইমন বিরক্ত কণ্ঠে বললো, 'কই? কীভাবে পাইলি? তালা ভাঙছিস নাকি?'
জামাল গুল্মঝোপের নিচ থেকে সোনালি পিতল পেল্গট বের করে ইমনের হাতে দিয়ে বললো, 'না, তালা ভাঙিনি। তালা খুলছি নকল চাবি দিয়া।'
ইমন একটু আশ্বস্ত হলো। তালা ভাঙলে ঘটনা প্যাঁচ লেগে যেতো। পিতল পেল্গট চারদিকে নেড়েচেড়ে দেখে বললো, 'এরই মধ্যে চাবি চুরি করে নকল চাবি তৈরি করে ফেলছিস। সাবাস! তোকে দিয়ে হবে।'
জামাল গলে গেল। বললো, 'এখন কী করবো এটার?'
'কিছুই করতে হবে না। তুই যেভাবে গোপনে পেল্গটটা নিয়ে এসেছিস ঠিক সেভাবেই আবার আগের জায়গায় রেখে আয়। কোনো প্রশ্ন করবি না। দ্রুত রেখে আয়, কথা আছে। আসার সময় চাবিটা নিয়ে আসিস। উল্টাপাল্টা কিছু করিস না।'
জামাল ইমনের এমন পরিবর্তনে ব্যাপক বিস্মিত হলো; কিন্তু সে কোনো প্রশ্ন করতে পারলো না। ইমনের কথার চুল পরিমাণ এদিক-সেদিক হতে পারে না। এটা তার মনের দুর্বলতা। ইমন তাকে জামাল বলে ডাকে হয়তো সেজন্যই। পিতল পেল্গট স্বস্থানে রেখে জামাল ফিরে এলো শিমুলতলায়। ফিরে এসে সে নকল চাবিটা ইমনের হাতে সমর্পণ করলো। ইমন চাবিটা তৎক্ষণাৎ ঝোপের পাশের দীঘির জলে নিক্ষেপ করলো সজোরে। ইমনের চাবি নিক্ষেপে জামালের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো এবং তার ভেতরকার এই দীর্ঘশ্বাসের ক্ষীণ শব্দটুকু মুহূর্তেই দীঘির শান্ত কালো জলে বেজে উঠলো টুপ করে।