খারাপ করলে যাকে নিয়ে সমালোচনা করি, ভালো করলে সেই তাকে নিয়েই লাফালাফি করি। ভুলে যাই অতীতের সব ভুল। হারলেও বাংলাদেশ, জিতলেও বাংলাদেশ।
বাংলার ক্রিকেটে সবকিছ যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এইতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগেও এ দেশের ক্রিকেটে ছিল সুখের বাতাস। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই দেশের ক্রিকেটে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা।
কথার লড়াই, সমালোচনা, ট্রল, মুশফিকের আয়নাকান্ড, রিয়াদের পেইন কিলার, লিটনের একের পর এক হতাশার গল্প, রানের ওপর ডিসকাউন্ট, বিসিবি সভাপতির পাল্টা জবাব, ক্রিকেটারদের সমালোচনা সহ্য করতে না পারার মানসিকতা, মাশরাফির ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়িয়ে কোচদের সমালোচনা করে ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট, সাকিবপতœীর তামিম-মাশরাফির দিকে ইঙ্গিত করা পোস্ট, মাশরাফির ভাইয়ের পাল্টা জবাব, সাকিবের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়াসহ নানান ইস্যুতে গরম ছিল বাংলার ক্রিকেট পাড়া। সেই সঙ্গে সুপার ১২-এর ৫টি ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ থেকে লজ্জাজনকভাবে বিদায় নিয়ে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
দেশে ফিরেই গত ১৯ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে তিন ম্যাচের পাকিস্তানের সঙ্গে টি- টোয়েন্টি সিরিজ। সেই সিরিজের জন্য স্কোয়াড় ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে আবারও বির্তক। বির্তক যেন থামছেই না। বাংলার ক্রিকেটে এখন আগুন জ¦লছে। মুশফিক, সৌম্য, লিটনকে বাদ দিয়ে স্কোয়াড়। লিটন সৌম্যকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করলেও মুশফিকের বিষয়টি নির্বাচকরা পরিষ্কার করে বলেননি। তবে অপরিষ্কার থাকা বিষয়টি মুশফিক নিজেই পরিষ্কার করে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। কোচের সঙ্গে মুশফিকের দূরত্ব স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন তিনি। সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে কোচের যেমন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে তেমনি লক্ষ্য করা যাচ্ছে আমাদের সিনিয়র ক্রিকেটারদের ভেতরও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বকাপের স্কোয়াড় দেওয়ার মাধ্যমে এই সমস্যা স্পষ্ট হয়েছে। তামিমের মতো অভিজ্ঞ একজন ওপেনার ছাড়া দল ঘোষণা। যেখানে তামিম নিজে থেকে সরে গেছেন বলে ফেসবুক লাইভে জানালেও মূলত মাহমুদুলস্নাহ এবং কোচ তাকে চায়নি এটা তিনি জানতে পেরেছেন। কোচ না চাইলেও অনেক সময় নির্বাচক এবং ক্যাপ্টেনের চাওয়াতেও খেলোয়াড়দের দলে রাখা হয়। যেমনটা মুশফিকের বেলায় হয়েছে। কোচ কিন্তু তামিম মুশফিক কাউকেই চায়নি। কিন্তু মাহমুদুলস্নাহ তামিমকে না নিলেও মুশফিকের জন্য রিকুয়েস্ট করেছেন। তাহলে কেন তামিমের জন্য রিকুয়েস্ট করেননি মাহমুদুলস্নাহ। বিষয়টা পরিষ্কার করেননি রিয়াদ নিজেও।
এরপর বিশ্বকাপে খেলতে গিয়ে খেলার চাইতে কথার তর্ক বেশি দেখা গিয়েছে। মাঠে মাহমুদুলস্নার এতগুলো ভুল সিদ্বান্তে সাকিব- মুশফিক একবারও নাক গলায়নি। সেটা বিশ্বকাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে খেলাটা দেখলে বুঝা যাবে। রিয়াদের পাড়ার ক্রিকেটের মতো ক্যাপ্টেনসি করার কান্ড দেখে সাকিবকে মাঠেই হাসতে দেখা গেছে। সাকিব মাসুমের মতো বোলার রেখে রিয়াদ নিজে বল করেছেন এবং করিয়েছেন আফিফকে। শুধু তাই নয়, এই ধরনের ক্যাপ্টিনসি তিনি ধারাবাহিকতার সঙ্গে করছেন। সেটা পাকিস্তানের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচেই দেখা গেছে। আমিনুল ইসলাম বিপস্নবকে একজন বোলার হিসেবে নিয়েও তাকে ১৯ ওভার পর্যন্ত একটা ওভার বল করাইনি রিয়াদ। এটাও ওই ডানহাতি-বামহাতিকান্ড। রিয়াদের এমন বাজে অধিনায়কত্ব দেখব এটা ভাবতেও পারিনি। অথচ এই মাঠেই অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে হারতে হচ্ছে লজ্জ্বাজনকভাবে।
ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ থেকে সাকিব, সাইফুদ্দিনের ছিটকে পড়া এবং তামিমের নেপাল প্রিমিয়ার লিগ থেকে ছিটকে পড়ার মাধ্যমে অনেকটাই অনিশ্চিত ছিল পাকিস্তান সিরিজ। সাকিব, সাইফুদ্দিনের বিষয়টা বাদ দিলেও তামিমের বিষয়টা আবার এখানে চলে আসে। তামিম যদি সুস্থ থাকত সে কি টি- টোয়েন্টি সিরিজে খেলতো? কারণ দূরত্বের ঘনত্ব যে দিন দিন বাড়ছে তাতে যে কোনো অজুহাত দেখিয়ে না খেলাটাই ছিল স্বাভাবিক। মাহমুদুলস্নার অধীনে তামিম ২০২২ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবে কিনা সেটা নিয়েও আমার সন্দেহ হচ্ছে। যদি মাহমুদুলস্নাহ নিজে তামিমকে রিকুয়েস্ট করে সেটা ভিন্ন বিষয়। নয়তো এই ডামিঙ্গো এবং রিয়াদের অধীনে তামিমকে আমরা '২২ বিশ্বকাপেও না দেখতে পারি।
তর্ক এখানেই শেষ নয়, তামিম ইকবাল কিন্তু ওডিআই অধিনায়ক। তামিম-রিয়াদের সম্পর্ক যদি অতিরিক্ত অবনতি হয়, তাহলে আমরা হয়তো রিয়াদকেও ওডিআই ক্রিকেটে না দেখতে পারি। তবে এসব কিছুই ক্রিকেটারদের মানসিক এবং খেলোয়াড় সুলভ আচরণের মাধ্যমে স্পষ্ট হবে। আমার ধারণা না মিললেই আমি সবচে খুশি হব।
তামিম ও রিয়াদের বিষয়টা একপাশে ফেলে রাখলেও কোচ এবং সিনিয়রদের বিষয়টা একপাশে রাখা যাবে না। এই যে ক্রিকেটারদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করা এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কোচের মাধ্যমে হচ্ছে। রিয়াদকে টেস্টে বাদ, তামিম-মুশফিককে টি- টোয়েন্টি থেকে বাদ এভাবেই দূরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে স্বয়ং কোচ। হয়তো রিয়াদকে ওডিআই থেকেও বাদ দিতে কোচ সুপারিশ করতে পারে। তখন অধিনায়ক তামিমও হয়তো চুপ থাকবেন। আর সম্পর্কেও ফাটল ধরবে আরও জোড়ালো। সেই সঙ্গে মুশফিকের বাদ পড়াটা আরও মারাত্মক। কখন আবার বাংলার ক্রিকেটের পোস্টারবয় সাকিবকেও বাদ দিয়ে দেয় এই কোচ সেটা নিয়েই আমি সন্দেহ প্রকাশ করছি। এভাবে চলতে থাকলে বাংলার ক্রিকেটে ঘোর অমানিশা নয়, ভয়ংকর রকম ঝড় আসবে। যে ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।
আবার আসা যাক মাঠের বিষয় নিয়ে। যে লিটন-সৌম্যকে আমরা দিনের পর দিন খেলিয়েছি, তাদের ওপর ইনভেস্ট করেছি, তাদের আমরা এক বিশ্বকাপেই বাদ দিয়ে দিলাম। এটা যেন একটা কমেডি। দর্শকের কথা শুনে যদি ক্রিকেট চালানো যেত তাহলে আর কথা ছিল না। তামিম তো বিশ্বকাপে সবসময় খারাপ খেলে। দর্শকরা তাকে ডটবাবা বলেও নাম দিয়েছে। কই তাকে তো বাদ দেওয়া হলো না তখন। আর এখন যখন বাদ দিয়েছেন তখন গ্যালারিতে সেই দর্শকরাই বলছে উই মিস ইউ তামিম। তামিমকে ফেরানোর জন্য তারাই এখন বিসিবিকে গালমন্দ করছেন। সুতরাং সেই দর্শকদের কথায় টি-টোয়োিন্ট থেকে লিটন সৌম্যকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি অযৌক্তিক। বিশেষ করে লিটন একজন ভালো মানের খেলোয়াড়। তার ব্যাটিং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসম্ভব। মূলকথা হচ্ছে, এই বিশ্বকাপটা তার জন্য কাল হয়ে এসেছিল। তাদের বাদ দিয়েছে মানলাম। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে কাদের দলে নিয়েছেন? টেস্টে থেকে ডাইরেক্ট টি-টোয়েন্টিতে অভিষক করা হয়েছে সাইফ হাসানকে। তার খেলা দেখে বুঝা যায় সে যেন জোর করে খেলছে। অপরদিকে নাঈম শেখ বিশ্বকাপে দুই ম্যাচে ভালো খেলেছে এটাই। পাকিস্তানের বিপক্ষে যথারীতি বাজে ফর্মেই আছে। তাহলে কী লাভ হলো? নির্বাচকরা আসলে কেন এই দায়িত্বে আছেন সেটা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের ক্রিকেটারদের ভেতর যেসব দ্বন্দ তৈরি হচ্ছে সেগুলোর অবসান করা জরুরি। এটা বিসিবি সভাপতিই চাইলে পারবেন। এই ডামিঙ্গো বাহিনীকে বিদায় দিতে হবে অতি কম সময়ের মধ্যে। প্রয়োজনে বিসিবির অন্য কোনো বিভাগে তাকে কাজ করতে দেওয়া যেতে পারে। নয়তো এক বছরের বেতন দিয়ে তাকে দেশের বিমানের টিকেট ধরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই এক বছর টাকা বাঁচানোর জন্য তার সার্ভিস নিতে গেলে দেশের ক্রিকেটের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে আশা রাখছি, আমাদের ক্রিকেটে ঘোর অমানিশা শিগগিরি কেটে যাবে। মুছে যাবে সব ব্যাথা, বেদনা, দুঃখ। কারণ দিন শেষে আমরাতো আমরাই।
খারাপ করলে যাকে নিয়ে সমালোচনা করি, ভালো করলে সেই তাকে নিয়েই লাফালাফি করি। ভুলে যাই অতীতের সব ভুল। হারলেও বাংলাদেশ, জিতলেও বাংলাদেশ।
আজহার মাহমুদ : প্রাবন্ধিক এবং কলাম লেখক