বছর বছর সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নানা উদ্যোগেও সড়কে হতাহতের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে ২ হাজার ২৯১ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ৩ হাজার ২৫৯টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে গতছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ৪২ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে এবং মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৬ বছরে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আহত হয়েছে ৯১ হাজার ৩৫৮ জন। ২০১৫ সালে ৮ হাজার ৬৪২ জনের মৃত্যু হয়। আর ২০২০ সালে করোনার লকডাউনে ৬৭ দিন যান চলাচল বন্ধ থাকলেও সড়কে দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিগত ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬ হাজার ৬৮৬ জনের মধ্যে ৭০৬ অর্থাৎ সাড়ে ১০ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী। পেশাওয়ারি হিসাবে চালক শ্রমিকের পর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীদের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় নিহতদের ২৪ জন মারা গেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়, যাদের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। পণ্যবাহী ভারী যানবাহন এবং হালকা অনিরাপদ যানবাহন একই সড়কে চলাচলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা আবারো সড়কে নেমেছেন।
সূত্র জানায়, সড়কে নিরাপত্তা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। বরং সরকার উল্টো অনেক বিধানই শিথিল করতে যাচ্ছে। কিশোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে ৮ বছর ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও তা পুরোপুরি প্রয়োগের আগেই মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে জেল-জরিমানা কমিয়ে তা শিথিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জীবিকা রক্ষার যুক্তিতে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত অবৈধ যানবাহনকে বৈধতা দেয়ারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তাছাড়া সরকারের করা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নেও গতি নেই। অদক্ষ চালক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে উঠলেও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকারি প্রকল্প চলছে ঢিমেতালে। গণসচেনতা বৃদ্ধির নামে সেমিনার, লিফলেট বিতরণ, দিবস পালন এবং মামলা-জরিমানাতেই সীমাবদ্ধ সরকারের কার্যক্রম। যদিও সড়ক পরিবহন সচিবের দাবি, সরকার সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। ওখানে কোনো ঘাটতি নেই।
সূত্র আরো জানায়, সরকার পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি মেনে সড়ক পরিবহনের আইনের ১২৬টি ধারার ২৯টিতে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। সংশোধানীর খসড়া আইন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভা বিভাগে পাঠিয়েছে। তাতে আইনে সবচেয়ে স্পর্শকাতর পরিবর্তনের প্রস্তাব হলো, ১০৫ ধারায় জরিমানা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে দ-বিধি ৩০৪ (খ) ধারায় চালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল তিন বছরের কারাদ-। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তা বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয়। সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়। এখন আইনের সংশোধনীর খসড়ায় জরিমানা কমিয়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই ধারার অপরাধের মামলা জামিন অযোগ্য ছিল। পরিবহন নেতাদের দাবির মুখে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করার মামলা এবং গাড়ির আকার-আকৃতি পরিবর্তনের মামলা জামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে বিগত ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর দেশে সড়ক আইন কার্যকর করা হয়। তখন থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আইনটিকে কঠোর ও তাদের স্বার্থবিরোধী আখ্যা দিয়ে আন্দোলনে নামে। তারা কঠোর আইন শিথিলের দাবিতে কর্মবিরতির অজুহাতে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে ব্যাপক জনদুর্ভোগের মুখে আইনের ৯টি ধারার প্রয়োগ স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো সঙ্গে দুই বছর আলোচনার পর সরকার সড়ক আইন সংশোধনের যে খসড়া প্রকাশ করেছে তাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবিরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, মালিক-শ্রমিকরা সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকে সমর্থন করেছে। মালিকরা আইনের একটি যৌক্তিক ধারাও পরিবর্তন চায়নি। দেশে মূল সমস্যা দক্ষ চালক সংকট। তা মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর কাজ নয়। তারপরও নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক জানান, সড়কে শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। ফলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাড়ছে। সরকারকেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন শিথিল করে, যথাসময়ে কাজ শেষ না করে, খালি কমিটি ও সুপারিশমালা করলে তা হবে না।