হাতি স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এরা
বন-পাহাড়ি এলাকায় দলবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করে। আমাদের দেশে যে হাতিদের
দেখা মেলে, এরা হলো ‘এশীয় হাতি’। এছাড়াও পৃথিবীতে আফ্রিকান প্রজাতীয়ও
হাতি রয়েছে। এশীয় প্রজাতীয় হাতি সাধারণভাবে তৃণভোজী। ঘাস, লতাপাতা, গাছের
বাকল, বাঁশ, ফলমূল, কলাগাছ ইত্যাদি হাতির পছন্দের খাবার। বিশাল শরীরের
কারণে তার প্রচুর খাবারের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি পুর্ন বয়স্ক হাতি প্রতিদিন
২৫০ কেজি খাবার এবং প্রায় ১৫০ লিটার পানি খেতে হয়। হাতির স্বাভাবিক আবাস
ও বিচরণক্ষেত্র প্রাকৃতিক বন ও তৃণভূমি। তাই তাকে টিকে থাকতে হলে
প্রাকৃতিক বন থাকা অপরিহার্য।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) প্রায় ১০ বছর
আগে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৩টি দেশে এখনো প্রাকৃতিক বনে এশীয়
হাতির দেখা মেলে। এদের অধিকাংশই ভারতীয় উপমহাদেশে। বর্তমানে এশীয় হাতির
প্রায় ৬৬ শতাংশ বন্য হাতি। অবশিষ্ট চিড়িয়াখানা, সার্কাস বা ব্যক্তিগত
মালিকানায় বন্দিদশায় বেঁচে আছে।
বিশ্বজুড়ে হাতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় হাতির
ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। হাতি খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বড় গাছের নিচের
অংশে বেড়ে ওঠা গাছপালা পরিচ্ছন্ন করে বনকে বদলে দেয়, প্রতিবেশ-ব্যবস্থায়
আনে নিজস্ব ধরনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন। হাতি নিজের প্রয়োজনে পানির ধারা না
পেলে পানির জন্য গর্ত খোঁড়ে; তাতে অন্য প্রাণীদেরও খাবার পানি মেলে। বনে
আগুন লাগলে তা ছড়িয়ে পড়ায় বাধা সৃষ্টি করে হাতির নিয়মিত চলার পথে তৈরি
হওয়া শূন্যস্থান। হাতির বিষ্ঠা বনবিস্তারে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের
বনে একসময় প্রচুর বন্য হাতি ছিল। এখনো এসব এলাকায় বন্য হাতির দেখা মেলে,
তবে তাদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। হাতির আবাসস্থল ও খাদ্য সরবরাহ
সংকুচিত হওয়ায় হাতির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী,
আমাদের দেশে প্রায় ২০০ বুনো হাতি এখনো টিকে আছে। এ ছাড়া আরো প্রায় ১০০
হাতি বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারতের মেঘালয়, আসাম, মিজোরাম ও ত্রিপুরার
সীমান্ত অঞ্চলে চলাচল করে। আন্তদেশীয় চলাচল ছাড়াও হাতির দল বা দলছুট হাতি
তাদের বসবাস এলাকাগুলোর মধ্যে যাতায়াত করে। হাতির চলাচলের পথে মানুষ
ঘরবাড়ি, বাগান, ফসলের খেত ইত্যাদি গড়ে তুললে হাতি সেগুলোতে হানা দেয়।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন কর্মকান্ডও বাড়ছে। বাড়ছে
নগরায়ণ। বনাঞ্চলে লোকবসতি, কৃষিকাজ, যোগাযোগের রাস্তা ও অন্যান্য
অবকাঠামো গড়ে উঠছে এবং তা সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে প্রকৃতির বন সংকুচিত ও
খন্ডিত হয়ে বিচ্ছিন্ন টুকরো বনভূমি তৈরি হচ্ছে। খন্ডিত বনাঞ্চল হাতি ও
অন্যান্য বন্য প্রাণীর বসবাসের নিরাপদ জায়গা নয়।
বাংলাদেশের বন্য হাতিরা শুধু আবাসিক নয়, পরিব্রাজক হাতিও রয়েছে। তারা
বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া করে। তাই বাংলাদেশ ও ভারত
সরকারের সম্মতিতে সীমান্তের বেড়ার কোথাও কোথাও খানিক উন্মুক্ত রাখা গেইট
নির্মান করা হয়েছে। তবে হাতিদের আন্তসীমান্ত চলাচলের আরও কার্যকর
ব্যবস্থা দরকার। প্রকৃতিতে হাতি সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগ ও আইইউসিএন
সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়েছে। বাংলাদেশে হাতি ও
মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ যেন না ঘটে, হাতির প্রতিবেশ যেন বিপন্ন না হয়,
হাতির খাদ্য যেন প্রকৃতিতে সুলভ হয় এবং এসব লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ
নেওয়া প্রয়োজন। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী
নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ের গজনি অঞ্চলে বন্য
হাতির উপযোগী খাদ্য চাষ করা হচ্ছে। যদিও ওই খাবার চাষ করার পরপরই বেশির
ভাগ অংশ হাতিই খেয়ে সাবার করে ফেলে। তারপরও ওইসব স্থানে সম্প্রতি কিছু
খাবার তৈরী হয়েছে বলে স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানাগেছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বাংলাদেশ সীমাস্তের কাছাকাছি এলাকার প্রাকৃতিক বন
কেটে ফলের বাগান, ফসলি জমি সম্প্রসারণ বেড়েছে। ফলে ওই এলাকার বুনো
হাতিগুলো বাংলাদেশের অবশিষ্ট প্রাকৃতিক বনে আশ্রয় নিচ্ছে। ওইসব হাতির
মধ্যে একসঙ্গে অর্থাৎ প্রতিটি দলে ১৫-৩০টি হাতির দল রয়েছে বলে সূত্রে
জানাগেছে। বিষয়টি বাস্তবেই লক্ষ্য করা গেছে সম্প্রতি শেরপুর সীমান্তে
হাতির বিচরণে।
এমতাবস্থায় হাতির চলাচল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ
চূড়ান্ত বিচারে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। ছোট এই দেশে প্রচুর
মানুষের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশিই বন্য প্রাণী ও মানুষের
সংঘাতহীন সহাবস্থানের কৌশল রপ্ত করতে হবে।
কিন্তু শেরপুর সীমান্তে গত প্রায় ৩০ বছর যাবত খাবারের সন্ধানে এই বন্য
হাতি তান্ডব চালিয়ে আসছে। ফলে সীমান্তবাসী মরিয়া হয়ে উঠেছে হাতি নিধনে।
বেসরকারী এক সমিক্ষায় দেখা গেছে, শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ি,
ঝিনাইগাতি ও শ্রীবর্দী উপজেলা সীমান্তের গারো পাহাড়ে গত ৫ বছরেই হাতি
মারা পড়েছে প্রায় ১৫ টি। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ৯ এবং ১৯ নভেম্বর পর পর
দুইটি হাতি মারা পড়ে। এরমধ্যে একটির পোস্ট মোটেম রিপোর্টে বিদ্যুতের তারে
জড়িয়ে হত্যা করার প্রমান পাওয়ায় শ্রীবর্দী উপজেলার বন বিভাগ শেরপুর
সীমান্ত এলকায় এই প্রথম হাতি হত্যার দায়ে ৪ জনকে মূল আসামি করে মামলা
দায়ের করেছে। অপর হাতিটও হত্যা করা হলেও স্থানীয়রা অত্যন্ত সুকৌশলে আলামত
সরিয়ে ফেলায় এবং পোষ্ট মোর্টেম রিপোর্ট মানুষের পক্ষে ধান খেয়ে পেট ফুলে
মৃত্যুর কারণ দেখানো হয়েছে। ফলে ওই হাতির মৃত্যু রহস্যই থেকে গেলো। তবে এ
অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের গারো পাহাড় এলাকার হাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত
হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে পারিবেশবাদীরা। ইতোমধ্যে হাতি হত্যার প্রতিবাদে
সোচ্চার হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও পারিবেশবিদরা। দফায় দফায় হাতি
হত্যার প্রতিবাদে এবং হাতির অভাশ্রম নিশ্চত করার দাবীদে মানববন্ধন ও
স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে জেলা প্রশাসকের কাছে। এমতবস্থায় সরকারের
এখনই উচিত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।
হাতি-মানুষের সংঘাত বা দ্বন্দ্ব নিরসনে ইতঃপূর্বে সরকার নানা উদ্যোগ
নিলেও নানা কারণে সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। এক অনুসন্ধানে জানাগেছে, শেরপুর
সীমান্তের গারো পাহাড় এলাকায় গত ৪০ বছর আগে যে পরিমান বন-জঙ্গল ও
জীববৈচিত্র ছিলো তা কমে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে। এর কারণ হিসেবে
জানা গেছে, ৪০ বছরে ওই পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় ভুমিহীন সহ দেশের বিভিন্ন
এলাকার নদী ভাঙ্গা মানুষ এবং নানা অপরাধের আসামিরা এসে এই পাহাড়ে আশ্রয়
নেয়। দেশের বন আইনের নানা ফাঁক-ফোকরে ভুয়া কাগজ তৈরী করে এবং কতিপয় অসাধু
বন কর্মকর্তার যোগসাজসে পাহাড়-বনের প্রায় আড়াই হাজার একর জমি দখল করে
বসতি স্থাপন করে। ফলে গভীর বনই হয়ে পড়ে লোকালয়। বর্তমানে ওইসব বন ভূমি
উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়েও ব্যার্থ হচ্ছে বন বিভাগ। এতে ওই বন-পাহাড়ের হরিণ,
বাঘ, বানর, ভাল্লুক, শুকর, বন মোড়গ, নানা প্রজাতীয় সাপসহ সরিসৃপ অনেক
প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন মাঝে মধ্যে হাতির দেখা মিললেও যে ভাবে হাতি
হত্যা শুরু হয়েছে তাতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে হাতিও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার
আশংকা প্রকাশ করছে প্রাণীবিদরা।
গত প্রায় এক যুগ আগে শেরপুরে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রিলংকা থেকে বেশ কয়েকজন
হাতি বিশেষজ্ঞ দল আসেন শেরপুরের হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে কর্মশালা
করতে। তখন ওই বিশেষজ্ঞদল শেরপুর ত্যাগের সময় স্থানীয় প্রশাসন তথা সরকারকে
পরামর্শ দেয় যে, হাতি-মানুষের সহাবস্থান তৈরী করতে পারলে হাতি-মানুষের
দ্বন্দ্ব যেমন কমবে তেমনি এই এলাকায় হাতি দেখতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে
পর্যটকরা ছুটে আসবে। তখন হাতি দেখতে ওয়াচ টাওয়ার নির্মান করে জেলার
পর্যটনকে সমৃদ্ধ করা যাবে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদলের পরামর্শমতে তৎকালীন
প্রশাসন প্রাথমিক জরিপ চালিয়ে এ প্রকল্প করা থেকে পিছিয়ে আসে। কারণ,
হাতির অভয়শ্রম করতে স্থানীয় শত শত আদিবাসীসহ হাজার হাজার মানুষকে অন্যত্র
সরিয়ে নিয়ে তাদের পুনরবাসন করা দূরহ বিষয়। সেই সাথে অর্থনৈতিক এবং
রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতির বিষয়তো রয়েছেই। তাই সেই থেকে হাতি-মানুষের
দ্বন্দ্ব নিরসনের ভাঁটা পড়ে যায়। সরকার পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসন স্থানীয়
পাহাড়িদের ক্ষেত-খামার আর ঘর-বাড়ি রক্ষায় হাতি তাড়াতে কেবল মাত্র মশাল
জ¦ালাতে কেরোসিন তেল, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন চর্টলাইট এবং আলোর জন্য
জেনারেটের ব্যবস্থা করা হয়। যেটা সাময়িক সমাধান। কিন্তু স্থানীয় সমাধানে
এখন পৌঁছতে পারেনি প্রশাসন। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নানা ভাবে। যেমন
ইতিমধ্যে হাতিকে লোকালয়ে আসতে বাঁধা প্রদানের জন্য পাহাড়-জঙ্গলে কাঁটা
জাতী গাছ যেমন, বরই, লেবু ও বেত আবাদ করা হয়েছে অনেক স্থানে। এছাড়া
সীমান্ত সড়ক বরাবর এবং যেসব স্থানে হাতির বিচরণ সেসব স্থানে সোলার
ফেন্সিং প্রকল্প করা হলেও সেটাও ভেস্তে যায়। সোলার ফেন্সিং প্রকল্পটি
ছিলো, সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে হাতিকে কেবল মাত্র শক দেয়া। যেমন প্রথম
পর্যায় জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলায় প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ জিআই তার জড়িয়ে
বেড়া নির্মান করে সন্ধার পর সে তারে সোলার পাওয়ার দেয়া হতো। এতে হাতি ওই
তারে শক খেয়ে বনে ফিরে যেতো। কিন্তু পরবর্তিতে দেখা গেলো কিছু তার হাতিরা
এবং কিছু তার স্থানীয় বনখেকো মানুষ ছিঁড়ে ফেলে। কারণ, হাতি বনে থাকলে
কাঠচোররা গাছ কাটতে বনে প্রবেশ করতে পারে না। এ ছাড়া গহীনে দখলদার মানুষ
পড়ে যায় বিপদে।
এসব নানা সমস্যার বেড়াজালে শেরপুর সীমান্তের মানুষ যেমন হাতি আতঙ্কে রয়েছে
তেমনি হাতি হত্যার কারণে হাতিরাও রয়েছে মানুষ আতংকে। তাই এই সমস্যার
সমাধানে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দ্রুত সমাধান বের করে ব্যবস্থা গ্রহন করা।
নইলে এ অঞ্চল থেকে এশীয় হাতিও একসময় বিলুপ্ত হয়ে পড়বে।