ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা-সংঘাত বীভৎস আকার ধারণ করেছে। ভোট চলাকালীন, এবং ভোট পরবর্তীতে প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার পরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুনখারাবির ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ১০টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলেন, বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকেরা এ হামলা চালান। এ হামলায় আহত হন অন্তত ১০ জন।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের মৃধারমোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। থানা-পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ধাপের লক্ষ্মীপুর ইউপিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল হকের স্ত্রী মৌসুমী সুলতানা। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তোফাজ্জেল হোসেন। এ নির্বাচনে বিজয়ী হন মৌসুমী সুলতানা। এরপর থেকে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে।
সংকট বিশ্লেষণকারী ব্রাসেলসভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) এক পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে যে, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতায় আবারও ‘অবনতিশীল পরিস্থিতি’র মানচিত্রে ফিরেছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইউপি নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে।
গত অক্টোবরেও একবার দুর্গাপূজার সময় গুজব, সংঘাত ও প্রাণহানির জন্য বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে অবনতিশীল বলে উল্লেখ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এবার গত নভেম্বর মাসজুড়ে নির্বাচনী সংঘাতে হতাহত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে আবার বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে অবনতিশীল তালিকায় রেখেছে আইসিজি।
এর আগে আইসিজি ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার কারণে বাংলাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতির তথ্য তাদের বিশ্লেষণে তুলে ধরেছিল।
ঢাকায় গত সপ্তাহে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের উদ্দেশে সরকারের ব্রিফিংয়ে ইউপি নির্বাচন ঘিরে সংঘাত ও মৃত্যুর বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন পরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলগুলোর অনেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে। উচ্ছ্বাস বেশি। একমাত্র খারাপ বিষয় হলো মৃত্যু। কোনো নির্বাচনেই আমরা একটি মৃত্যুও চাই না। তবে আমি জানি না এটি কিভাবে সম্ভব।’
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে নির্বাচনী সহিংসতাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচনে সহিংসতাগুলোর বেশির ভাগই হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।
আইসিজি তাদের প্রতিবেদনে গত নভেম্বরের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে ৪৫ জনেরও বেশি নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ওই নির্বাচন বর্জন করেছে (বস্তুত বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছেন)। নরসিংদীতে গত ৪ নভেম্বর সংঘর্ষে তিনজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। গত ৫ নভেম্বর কক্সবাজারে সংঘর্ষে নিহত হয় একজন। পাবনা ও মেহেরপুরে গত ৮ নভেম্বর সংঘর্ষে দুজন নিহত এবং ৩৫ জন আহত হয়। ভোটের দিন নরসিংদী, কুমিল্লা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় সংঘর্ষে অন্তত সাতজন নিহত হয়। সেদিন দেশজুড়ে নির্বাচনী সহিংসতায় শতাধিক লোক আহত হয়।
সরকার তার সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা অব্যাহত রেখেছে বলেও ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে, ওই আইনের আওতায় কর্তৃপক্ষ গত ২ নভেম্বর দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে এবং গত ৮ নভেম্বর তিনটি মামলায় ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে।
এদিকে, পূর্ব ঘোষিত পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের তারিখ ঠিক রেখে পুনঃতফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি )। নতুন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগের মতোই আগামী ৫ জানুয়ারি দেশের ৭০৭টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তবে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় বাড়ানো হয়েছে।
সম্প্রতি কমিশনের বৈঠক শেষে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে পুনঃতফসিল ঘোষণা করেন ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর। এদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে কমিশনের ৯১তম সভা নির্বাচন ভবনের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পঞ্চম ধাপের নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হয়।
পুনঃঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ৯ ডিসেম্বর (আগে ছিলে ৭ ডিসেম্বর), মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ১২ডিসেম্বর (আগে ছিল ৯ ডিসেম্বর) এবং মনোনয়নপত্র প্রত্যাহাররের শেষ তারিখ ১৯ ডিসেম্বর (আগে ছিল ১৫ ডিসম্বর)। পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ জানুয়ারি।
এর আগে, গত ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপের দুই দফায় ৩৬৯টি, ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি এবং ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে এক হাজার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চতুর্থ ধাপে আগামী ২৩ ডিসেম্বর ৮৪০টি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রসঙ্গত, দেশে চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার হাজার ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাকিগুলোতে মামলা জটিলতার কারণে নির্বাচন আটকে রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত নয় বার ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে প্রথম ইউপি নির্বাচন এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে নবম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩, ২০১১ ইউপি নির্বাচন হয়েছে। চলতি ২০২১ সালে জুন-জুলাই মাস থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দশম ইউপি নির্বাচন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথম বারের মতো দলীয় প্রতীকে নবম ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের ২২ মার্চ থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ছয় ধাপে চার হাজার ২৭৫টি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।