পৌষের শুরুর দিন থেকেই দেশজুড়ে কমতে শুরু করেছে তাপমাত্রা। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চল মুড়িয়ে যাচ্ছে কুয়াশার চাদরে। কারও কারও জন্য এ শীত উপভোগ্য হয়ে উঠছে প্রতিদিনই। কিন্তু কাউকে পোহাতে হচ্ছে ঠান্ডাজনিত রোগে দুর্ভোগও। বিশেষ করে ঠান্ডাজনিত রোগে প্রতিদিনই শিশুরোগী বাড়ছে হাসপাতাল-গুলোতে। বাড়ছে চর্মরোগজনিত রোগীও। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালেই এসব রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। তবে একটু স্বাস্থ্যকর খাবার, সতর্কতা আর পরিচ্ছন্ন জীবন-যাপন এসব রোগ থেকে বাঁচতে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
সরেজমিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় এসব হাসপাতালের শিশু বিভাগ এবং চর্মরোগ বিভাগে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। শুধু রাজধানী নয় রাজধানীর বাইরে থেকেও চিকিৎসা নিতে এসব হাসপাতালে আসছেন রোগীরা।
রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ৩ বছর বয়সী শিশু সন্তানকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা আলমগীর হোসেন বলেন, আমার ছেলেটা খুবই প্রাণবন্ত। হঠাৎ ঠান্ডায় প্রথমে হালকা সর্দি হয়। এর একদিন পরেই আসে জ্বর। দুই দিনের মধ্যে কাহিল হয়ে যাওয়ায় নিয়ে আসি হাসপাতালে। এখন চিকিৎসকরা বলছেন, বুকে কাশি জমে নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। যা এর আগে কখনই তার ছিল না। এখন হাসপাতালের বারান্দায় বসে ছেলের সুস্থতার জন্য অপেক্ষা করছি। একইভাবে দিশাহারা দিন পার করছেন গাইবান্ধা থেকে ২ মাসের শিশুকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আসা প্রিন্স তালুকদার। তিনি বলেন, জন্মের সময়ই তার কিছুটা নিউমোনিয়ার ভাব ছিল। কিন্তু চিকিৎসকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সুস্থও হয়। কিন্তু উত্তরবঙ্গে হঠাৎ করে এত ঠান্ডা পড়ল যে একদিনের মধ্যে ছেলেটা কাহিল হয়ে গেল। দেরি না করে ঢাকায় নিয়ে আসি। চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তাকে বসে বসে ডাকছি তার সুস্থতা কামনা করে।
হঠাৎ করে দেশজুড়ে ঠান্ডাজনিত শিশুরোগীর পরিমাণ হাসপাতালে বাড়ছে বলে স্বীকার করেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ শফি সৈয়দ শাফি আহমেদ। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, হাসপাতালগুলোতে কয়েকদিনের ব্যবধানে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ঠান্ডাজনিত শিশু রোগী ভর্তি হয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই জ্বর, সর্দি থেকে শুরু করে এ্যাজমাও রয়েছে। এছাড়াও অন্তত ১০ থেকে ১২ শতাংশ নিউমোনিয়ার রোগী রয়েছে ভর্তি। হঠাৎ শীত পড়ায় অভিভাবকরাও বুঝতে পারেন নি যে শিশুরা এত দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই সচেতনতার বিকল্প নেই। শিশুরা যেহেতু অত্যন্ত সংবেদনশীল তাই এ সময়টায় তাদের বেশি করে যত্ন নিতে হবে। ঠান্ডা পানিতে গোসল করানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সাবান ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সাবধানী হতে হবে। এছাড়া বাচ্চাদের অবশ্যই পুরোটা সময় গরম কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনভাবেই শিশুর ঠান্ডা না লাগে।
একই কথা বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ এস এম মাহমুদুজ্জামান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত ২ সপ্তাহের ব্যবধানে শীতকালীন নানা রোগে অন্তত ৪০ শতাংশ নতুন শিশু ভর্তি হয়েছে ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে। এর মধ্যে নিউমোনিয়া, সাধারণ সর্দি-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস এবং ডায়রিয়ার রোগী রয়েছে। এ সময়ে কুয়াশা ও ধুলোবালির কারণে সাধারণত শিশুরা প্রাথমিকভাবে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়। যা পরে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তাই এক্ষেত্রে যদি জ্বর কিংবা সর্দি হয় তাহলে কোন অবহেলা না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আর যদি শ্বাসকষ্ট বা অসুস্থতা বৃদ্ধি পায় তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে।
তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিভাগের পাশাপাশি চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগেও দেখা গেছে রোগীদের ভিড়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে জটিল জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত রোগীরা এখানকার বহির্বিভাগে অপেক্ষা করছেন চিকিৎসকদের দেখানোর জন্য। রাজধানীর খিঁলগাও এলাকা থেকে আসা নারায়ণ আচার্য্য তাদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন, আমি লিভার সিরোসিসের রোগী। গত বছর ভারত থেকে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে এসেছি। এতদিন ভালই ছিলাম। কিন্তু শীত পড়তে পড়তেই সারা শরীরে শুরু হয়েছে তীব্র চুলকানি। এই চুলকানি সহ্য করতে না পেরেই এখানে এসেছি। এদিকে পুরো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করছেন রাজধানীর মহাখালীর বাসিন্দা রহমত উল্লাহ। তিনি বলেন, প্রথমে আমার বয়স্ক মায়ের শরীরে স্ক্যাভিস রোগটি হয়। পাত্তা না দিয়েই ছোট মেয়েটা তার পাশে ঘুমাচ্ছিল। পরে সে আবার আমাদের সঙ্গে ঘুমাতে আসে। এটা যে এমন একটা ছোঁয়াছে রোগ তা তো জানতাম না। এখন পুরো পরিবার আক্রান্ত হয়েছি। তাই চিকিৎসা নিতে এসেছি এখানে।
তবে শীতকালে চর্মরোগ বেড়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক বলে জানান হাসপাতালে চর্মরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক রাশেদ মোহাম্মদ খান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এ সময় বাতাসের আদ্রতা থাকে বেশি। শুষ্ক আবহাওয়ায় ত্বকও শুষ্ক হয়ে পড়ে। ফলে স্ক্যাভিস, শরীর চুলকানো, স্কিন ড্রাই হয়ে যাওয়া, খুশকি, হাত-পায়ে অস্বাভাবিক ঘাম, দুর্গন্ধের মতো চর্মরোগগুলো বাড়ে। ফাঙ্গাল ইনফেকশনের রোগীও পাওয়া যায়। তাই এ সময়টায় যতটা পারা যায় গোসলের সময় সাবান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শুষ্ক সাবানের পরিবর্তে গ্লিসারিনযুক্ত সাবান ব্যবহার করতে হবে। বাড়াতে হবে ময়েশ্চারাইজিংয়ের ব্যবহারও। বাইরে বের হতে গেলে অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। এইসব চর্মরোগ আপাত দৃষ্টিতে খুবই ছোট বিষয় মনে হলেও অবহেলায় এগুলোই একটা পর্যায়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, কিডনি, থাইরয়েডের মতো জটিল রোগে আক্রান্তদের চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অন্য রোগীদের চাইতে অনেক বেশি। তাই শীত থেকে বাঁচতে উলের কাপড়ের পরিবর্তে মোটা সুতির কাপড় ব্যবহার করতে হবে। এ সময় সোরিয়াসিস নামের আরেকটি জটিল চর্মরোগও হয়। স্কিন খুব বেশি ড্রাই হলে এটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এক্ষেত্রে ময়েশ্চারাইজিংয়ের বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, এছাড়া স্ক্যাভিস তো রয়েছেই। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াছে রোগ। পরিবারের একজন কারও এটি হলে অন্যদেরও হবে। বিশেষ করে কেউ যদি এক বিছানায় ঘুমায় তার তো হবেই। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সঠিক নিয়মে ওষুধের ব্যবহার করতে হবে আক্রান্ত সবাইকে। এ মুহূর্তে ঠিক কতজন রোগী ঢাকা মেডিক্যালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে এসব জটিল রোগে আক্রান্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, শীতের শুরু থেকেই আমাদের বহির্বিভাগে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে এসব রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। যা নিজেদের সচেতনতায় অনেকটাই ভাল থাকা সম্ভব। সানস্ক্রিন, ময়েশ্চারাইজারের মতো দামী উপাদানগুলো সাধারণ জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে অন্তত ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় রোগী কিছুটা কম আছে বলে জানান স্যার সলিমুল্লাহ কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ রাশেদ উন নবী। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা আপাতত কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছি। করোনার উর্ধগতি কমার পর ডেঙ্গুরোগীদের নিয়ে খুব চাপে ছিলাম। একটা সময় এখানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪শ’র বেশি। যা বর্তমানে ১ হাজারের মধ্যে রয়েছে। এছাড়া ঠান্ডাজনিত রোগীও খুব একটা বেশি নেই।