বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিউবার সংগ্রামী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’
সত্যিই তাই। ব্যক্তিত্ব বা সাহস কোনো দিক থেকেই কম ছিলেন না আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার পরেও জনমানুষের চিন্তা মাথায় নিয়ে জনমানুষের মাঝে মিশে থাকতেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। এ ব্যাপারে ১৯৭৩ সালের একটা ঘটনা বলা যায়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের জন্য বঙ্গবন্ধু গেলেন বরগুনায়। হেলিকপ্টার থেকে নামলেন তিনি। লক্ষ লক্ষ মানুষের স্লোগানে মুহুর্তে মুখরিত হয়ে গেলো এলাকা। শুধু স্লোগান দিয়েই ক্ষান্ত নয়, নিরাপত্তা বলয় ভেঙে পাগলের মতো বঙ্গবন্ধুর দিকে ছুটে আসতে শুরু করলো জনতা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী মহিউদ্দিন পথ আগলে দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধু তাকে সরিয়ে দেন। তিনি চিৎকার করে বলেন, "খবঃ ঃযবস শরষষ সব."
এ ঘটনা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয় কীভাবে মানুষের ভালোবাসায় মিশে থাকতে চাইতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাড়ির দাড়োয়ান, গাড়ির ড্রাইভার কেউ তাঁর কাছে ছোট ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর দূর্লভ একটা ছবি ইন্টারনেট দুনিয়ায় কয়েক বার দেখেছি। তাঁর বাড়ির দাড়োয়ানকে তিনি হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একসাথে বসে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাবেন বলে। এভাবেই একজন অসাধারণ মানুষ হয়েও সাধারণ মানুষের মাঝে সাধারণ মানুষের মতো করেই তিনি বাঁচতেন।
সমাজের শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে অগাধ ভালোবাসা ছিল তা উপলব্ধি করতে কারো সমস্যা হয় না। ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ তাঁর জীবনের শেষ ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "আপনি চাকরি করেন। আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মায়না দেয় ঐ খনির শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়, আমি গাড়ি চলি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক।" এভাবেই তিনি চেয়েছিলেন সমাজে শ্রমজীবী মানুষদের সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে। কারণ যে সমাজ শ্রমজীবীদের সম্মান দিতে পারে না, সে সমাজ অসভ্য ছাড়া কিছুই নয়।
আমাদের অনেকেরই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক আগ্রহ রয়েছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। আমাদের অনেকেই নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে চিনি কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তিনি কেমন ছিলেন তা জানি না। বলা যায়, আমজনতার মতোই ব্যক্তিজীবনে তিনিও ছিলেন অতি সাধারণ একজন বাঙালি। পরিবারের কর্তা যেমন সবসময় পরিবারের সবকিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন তেমনি বঙ্গবন্ধুও জীবনের কঠিন সব মুহুর্তের মুখোমুখি হয়েও অতি সাধারণ সব বিষয় নিয়েও চিন্তা করতে ভোলেননি।
আমরা বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে চিনি। তার সৌভাগ্য হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর সাথে সরকারিভাবে কাজ করার। ২০১৯ সালে তিনি এক বক্তৃতা দিতে গিয়ে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, "ঘটনাটি ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লূৎফর রহমান যেদিন মারা যান, সেদিন আমি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সারাদিন ছিলাম। চল্লিশার দিনে ঠিক হয়, বঙ্গবন্ধু টুঙ্গীপাড়ায় যাবেন। সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ, তিন বাহিনীর প্রধান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থাকবেন।
গাজী জাহাজে টুঙ্গীপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। আমার জাহাজ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকায়, কাপড়-চোপড় সঙ্গে নেয়ার কথা মনে হয়নি। রাতে জাহাজ ছাড়লে দেখি, আমার শোবার কোনো জায়গা নাই। একপাশে একটি খালি সোফা পেয়ে শুয়ে পড়ি। পাশেই তখনকার এডিসি রাব্বানী সাহেব ছিলেন। মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি, রাব্বানী জেগে আছেন। আমার মাথার নিচে বালিশ। আমি অবাক হয়ে রাব্বানীকে জিজ্ঞেস করি, 'এই বালিশ আমার মাথার নিচে কে দিলেন?' রাব্বানী বলেন, 'রাতে বঙ্গবন্ধু রাউন্ডে এসেছিলেন। তিনি দেখেন- আপনি মাথার নিচে হাত দিয়ে সোফায় শুয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রুমে গিয়ে বালিশ নিয়ে এসে আপনার মাথার নিচে রেখে গেছেন।'"
বলে রাখা ভালো, মাথার নিচে দুটো বালিশ না দিলে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতে পারতেন না। তবু তিনি একজন রাষ্ট্রপতি হয়েও তাঁর একটা বালিশ এসে দিয়ে গিয়েছিলেন মাহবুব তালুকদারের মাথার নিচে। এ ঘটনাটি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন মাহবুব তালুকদার।
সবার প্রতি এমনই সাধারণ আর যতœবান একজন মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতার মতো স্নেহ করতেন তিনি এই বাংলার মানুষকে। অগাধ ভরসা করতেন। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি ছিলেন আপোষহীন। অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে বারবার গর্জে উঠেছেন সাহসীকতার সাথে। ৭ই মার্চের সেই বিশ্ববিখ্যাত ভাষণ ছাড়াও তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই এ বিষয়টি বেশ লক্ষণীয়।
তবু কিছুকিছু আক্ষেপ তাঁর যে ছিলো তা বলতেই হয়। যেমন: একবার এক গরীব কৃষক ভালোবেসে তার নিজের ক্ষেতের কিছু সবজি নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। বঙ্গবন্ধু তখন দোতলায় টেলিফোনে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কেয়ারটেকার মুহিত দোতলায় উঠে তাঁকে ব্যাপারটা জানালেন। টেলিফোনে কথা বলা অবস্থাতেই তিনি তাঁর পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে কেয়ারটেকারের হাতে দিলেন। কেয়ারটেকার ভাবলেন, সামান্য কিছু সবজির জন্য বিশ টাকা দেয়ার কোনো মানে হয় না। তিনি দশটা রেখে বাকি দশ টাকা গিয়ে দিলেন কৃষকের হাতে। টাকা পেয়ে কৃষক যারপরনাই অবাক হলেন এবং দৌঁড়ে দোতলায় উঠে বঙ্গবন্ধুর কাছে দশ টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, "এগুলো আমার ক্ষেতের সবজি। আমি আপনার জন্য এমনি এনেছি, টাকা লাগবে না।"
জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, "কিন্তু আমি তো বিশ টাকা দিয়েছিলাম।"
কৃষক অবাক হয়ে জবাব দিলেন, "উনি তো আমাকে দশ টাকা দিলেন।"
বঙ্গবন্ধু তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "যে দেশে দোতলা থেকে নিচতলায় পৌঁছতে পৌঁছতে বিশ টাকা দশ টাকা হয়ে যায়, সে দেশে কত টাকার বাজেট প্রনয়ণ করলে তা জনগণের নিকট পৌঁছবে?"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য বৈশিষ্ট্যটি ছিলো তাঁর অতুলনীয় নেতৃত্বগুণ। ৭ই মার্চের ভাষণে যখন দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, "প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে," তখন মানুষ তার নেতৃত্বে প্রতিটি ঘরকে করে তুলেছিলো দূর্গ, লড়াই করেছিলো নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে। অনেকে এই ধারণা পোষণ করেন, শুধুমাত্র ৭ই মার্চের ভাষণের কারণেই বঙ্গবন্ধু বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তবে এ ধারণাটি যে মোটেও সত্য নয় তা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পূর্ববর্তী জীবন ও কর্ম দেখলেই অনুভব করা যায়। আবার, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "যদি আরো দু মাস লাগতো কি তিন মাস লাগতো স্বাধীন হতে, তোমরা যুদ্ধ করতা না? যদি এক বছর লাগতো, যুদ্ধ করতা না? না খেয়ে কষ্ট করতা না? তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করতা না? গুলি খেয়ে মরতা না? এই এক বছর তোমাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে আমার দেশের গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে," তখনও একইভাবে বাংলাদেশের মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিলো দেশ গঠনের কাজে।
বিশ্ব ইতিহাসে এমন নেতৃত্ব সত্যি বিরল। এজন্যেই তিনি ওয়াশিংটনের নিউজউইক ম্যাগজিনের মতে রাজনীতির কবি, বিবিসির মতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এজন্যেই তিনি মহানায়ক। আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমরা এই মহান নেতাকে আগলে রাখতে তো পারিইনি উপরন্তু তাঁর আদর্শকেও কাজেকর্মে ভুলতে বসেছি। তবে আমরা যদি শুধু মুখে মুখে না বলে তাঁর আদর্শকে সত্যিকার অর্থেই নিজেদের মধ্যে ধারণ করে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারি তবে আমাদের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।