প্রতিদিনের পত্রিকায় আমরা অহরহ দেখছি ছাত্র-যুব-জনতার অপমৃত্যুর সংবাদ। দৈনিকের পাতায় মৃত্যুর আগের হাসির ছবি আর মৃত্যুর সংবাদ দুটো বিষয়কে এক করতে গেলেই দুঃখঞ্জয় হয়ে ওঠে মন। তবু সাহসের সাথে থাকি প্রতিক্ষণ, আশায় বাঁধি বুক আমরণ। এই আশার আলো জ¦ালতে জ¦ালতে এগিয়ে চলা লোভ মোহহীন আমি যখন দেখলাম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাঈদা গাফফারকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ১৪ জানুয়ারি সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর থানার পাইনশাইল এলাকার শিক্ষক আবাসন প্রকল্পের নির্জন স্থানে ঝোপের ভেতর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি দুদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। এর আগে বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) রাতে এ ঘটনায় জড়িত মো. আনোয়ারুল ইসলাম নামে এক রাজমিস্ত্রিকে গাইবান্ধা থেকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, নির্মাণসামগ্রীর টাকা ছিনিয়ে নিতেই অধ্যাপক সাঈদা গাফফারকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন রাজমিস্ত্রি আনোয়ারুল। আনোয়ারুল ইসলাম গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর থানার বুজর্গ জামালপুর গ্রামের আনসার আলীর ছেলে। নিহত সাইদা গাফফার ঢাবির পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তার স্বামী প্রয়াত কিবরিয়াউল খালেকও ঢাবির শিক্ষক ছিলেন। সাইদা ২০১৬ সালে অবসরে যান।
একজন বিশ^বিদ্যালয়কে কেন খুন হতে হবে? কারণ একটাই দেশে আইনের সংস্কৃতি বা বিচারের সংস্কৃতি নাই। থাকলে একজন বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে কেউ কখনো খুন করা তো দূরের কথা, চোখের দিকে তাকিয়ে দেখার সাহসও হতো না কারো। অথচ খুন হচ্ছে, খুনের পর আসামীকে কোন একভাবে গ্রেফতার করার পর পুলিশ খুব বুক ফুলিয়ে বলছে- গ্রেফতার করেছি। কিন্তু তারা একবারের জন্যেও ভাবছে না যে, জাতিকে কোনভাবেই নিরাপত্তা দিতে পারছে না। নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ পুলিশ-প্রশাসন হয়তো একারণেই নির্লজ্জের মত অবিরত তাদের সাহসগীরি দেখানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো- দেশটা চরম বিপর্যয়ের পথে এগিয়ে চলছে। তা ভুলে গিয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের কোনাবাড়ি জোনের সহকারী কমিশনার আবু সায়েম নয়ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সাইদা গাফফার কাশিমপুরের পাইনশাইল এলাকায় একটি ভাড়াবাসায় একা থেকে পাইনশাইল এলাকায় অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসন প্রকল্পে তাদের একটি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ করাচ্ছিলেন। গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর থেকে তার পরিবারের লোকজন মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও অধ্যাপক সাইদার কোনো সন্ধান পাচ্ছিলেন না। পরদিন ১২ জানুয়ারি তার মেয়ে মোসা. সাহিদা আফরিন এ ব্যাপারে কাশিমপুর থানায় একটি জিডি করেন। ওই শিক্ষিকার প্লটে নির্মাণাধীন বাসায় আনোয়ারুল নামে এক রাজমিস্ত্রি কাজ করেন। ১১ জানুয়ারি কাজ শেষে রাজমিস্ত্রি আনোয়ারুল ও তার সহকারীরা সকলেই প্রকল্প এলাকা ত্যাগ করেন। পরদিন সহকর্মীরা কাজে যোগ দিলেও আনোয়ারুল অনুপস্থিত ছিলেন। পরে জিডির তদন্ত করতে গিয়ে প্রাপ্ত তথ্য এবং আনোয়ারুলের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার রাতে তাকে গাইবান্ধা থেকে আটক করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্য মতে শুক্রবার সকালে প্রকল্প এলাকার ঝোপের ভেতর থেকে সাইদা গফফারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশের ভাষ্যনুযায়ী, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আনোয়ারুল স্বীকার করেছেন- ১১ জানুয়ারি বিকেলে কাজ শেষে নির্মাণসামগ্রী ও মালপত্র কেনার টাকা নিয়ে প্রকল্প এলাকা থেকে ফেরার পথে প্রকল্পের ভেতরে নির্জন এলাকায় তিনি অধ্যাপক সাইদা গাফফারের সঙ্গে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সাইদা ডাকচিৎকার করলে গলার ওড়না চেপে ধরে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর টাকা ছিনিয়ে নিয়ে রাতেই গাইবান্ধা চলে যান। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে সাউদ ইফতেখার জহির বাদী হয়ে আটক আনোয়ারুল ইসলামকে আসামি করে কাশিমপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলা, সেই মামলা যা-ই হোক না কেন নির্মম মৃত্যুর শিকার মানুষটি কি আর ফেরত পাবেন সুন্দর এই পৃথিবী? পাবেন না। মনে রাখতে হবে- এক একটি জীবনের সঙ্গে একেকটি স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে। একটি মৃত্যু সব কিছু শেষ করে দেয়। অনেকে জীবনের মূল্য না বুঝে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। আবার অনেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও জীবন তার কাছ থেকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। বর্তমানে নিজ ঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা কোথাও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিনই মানুষ কোন না কোন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেকে আবার বিভিন্ন কারণে জীবনের প্রতি অনীহা এসে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এসব মৃত্যুই অপমৃত্যু হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
বর্তমানে সারাদেশে এমন অপমৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এমন একটি দিনও নেই। প্রতিদিনই অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে সব বয়সী মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের। ট্রেনে কাটা পড়েও মানুষের অপমৃত্যু ঘটছে। এছাড়া বিষপানে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে, চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে, ঘুমের বড়ি খেয়ে, শরীরে আগুন দিয়ে এবং নদীতে ঝাঁপ দিয়ে অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আবার কোন কোন ঘটনায় খুন করে আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয়েছে বলে ঘাতক চক্র চালিয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের খুনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রহস্য উদ্ঘাটন হয় না। দেশে অপমৃত্যুর ঘটনা এভাবে বেড়ে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রে। এমন করে কেন চলবে বাংলাদেশ? কেন নির্মম মৃত্যু বাড়ছে-বাড়ছে অপমৃত্যু?
প্রশ্নের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে তথ্য খুঁজেছি। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সরকারি তথ্য থেকে জেনেছি- গত ৬ বছরে ১ লক্ষ ২২ হাজার ৩১৫ টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ২০ হাজার ৩২০ টি, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ৫৫১টি, ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৩২৯টি, ২০১৯ সালে ১৭ হাজার ১২০টি, ২০২০ সালে ২৩ হাজার ২৩৮টি এবং ২০২১ সালে ২০ হাজার ৭১৬টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত ৬ বছরে ১ লক্ষ ২২ হাজার ৩১৫ টি অপমৃত্যুর ঘটনার মধ্যে ৭১ হাজার ৭৬০টি ঘটনা কোন না কোন নির্মম ঘাতকের হাতে ঘটেছে। চলতি বছর জানুয়ারির এই ১৬ দিনে সারাদেশে সন্ত্রাসী-সিরিয়াল কিলারসহ বিভিন্ন ধরনের খুনীদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছেন ৯৯ জন, গলায় ফাঁস দিয়ে ৭৭টি, বিষপানে ২২টি এবং গায়ে আগুন লাগিয়ে ১৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। নারীরা যৌতুক, স্বামীর পরকীয়াসহ দাম্পত্য কলহের জের ধরে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। বাংলাদেশের রাজপথে থাকা একজন নগণ্য মানুষ হিসেবে বলতে পারি- যত অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন, প্রতিটি অপমৃত্যুর পেছনে রয়েছে আমাদের রাষ্ট্রিয় অব্যবস্থাপনা দায়ি হিসেবে। রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য আর অন্ধকারের ঘণঘটাও কম দায়ি নয়; অর্থনীতিকে কারা ধ্বংস করছে, যারা ধ্বংস করছে অর্থনীতিকে, তারাই আমাদের দেশের প্রতিটি অপমৃত্যুর জন্য দায়ি। একই সাথে দায়ি আমাদের বিচার ব্যবস্থা, আমাদের আইনের প্রতি অসম্মান।
একজন নিরন্তর রাজপথ সৈনিক হিসেবে বলতে চাই- আমাদের দেশকে নিরাপদ করতে-জনগনকে নিরাপত্তা দিতে তৈরি হতে হবে বাংলাদেশ সরকার আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-দপ্তর-অধিদপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্তকর্তা-কর্মচারিকে। যাতে করে আর কোন নারীকে টাকার জন্য নির্মম খুনের শিকার না হতে হয়; যেন না হয় আর কোন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিকে খুনের শিকার। আমরা চাই- জনতার অধিকার। আর সেই অধিকার রক্ষার জন্য নিমগ্নতায় অগ্রসর হতে হবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে। সেই ভালোবাসা যেন নির্মম খুনীদের হাত থেকে রক্ষা করে দেশকে-মানুষকে। প্রতিষ্ঠিত হয় বিচারের সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের সংস্কৃতি...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি