একটি তিলোত্তমা শহর ক্রমশই যখন বসবাসের অনুপযুক্ত হয় তখন বুঝতে হবে সেই শহর ঘিরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং বহুমুখী দূষণে বিপর্যস্থ অবস্থা রয়েছে। আমাদের রাজধানী ঢাকা পৃথিবীতে বসবাসের অনুপযুক্ত শহরের তালিকায় ক্রমশই ওপরের দিকে উঠে আসছে। যখন এই শহর বসবাসের জন্য অনুপযুক্তের তালিকায় প্রথম স্থানে আসে তখনও এই শহরে মানুষ বসবাস করবে, করতে হবে। বায়ু দূষণ পৃথিবীর বহু জনাকীর্ণ দেশেরই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। দখল-দূষণে রাজধানী আজ বিপর্যস্থ। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, আলো দূষণ, মাটি দূষণ এসব দূষণেই ঢাকা মারাত্বক অবস্থা ধারণ করছে। একটির সমাধান করতে গেলে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। ঢাকার বায়ু দূষণ ক্রমেই মারাত্বক আকার ধারণ করছে। সম্প্রতি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বায়ু দূষণ ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে। সংগঠনটির গবেষণা বলছে, গড়ে ২০২০ সালে বায়ুমান সূচক অনুযায়ী দূষণের মাত্রা ছিল ১৪৫। যা ২০২১ সালে এসে হয়েছে ১৫৯ দশমিক ১। সংগঠনটি বলছে, ৬০ শতাংশ বায়ু দূষণ হয় রাতের বেলা। বলা যায়, ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনটারই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। এগুলোর তালিকা তৈরি করলে অনেক লম্বা হবে। এবং কোনটির আগে কোনটি সমাধান করা হবে তা নিয়েই ভজঘট লেগে যাবে। এসব সমস্যা কার্যত এই শহরটাকে অকার্যকর করে ফেলছে। এই শহরে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিন সমস্যা নিয়েই বাসা থেকে বের হচ্ছে আবার সমস্যার মাঝেই বাড়ি ফিরছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকামুখী হচ্ছে। এদের অনেকেই আবার সেখানে স্থায়ী বসবাস করার জন্য চেষ্টা করছে। অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। সেই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এতে আমাদের প্রাণশক্তি গাছপালা কাটা যায় প্রচুর। গাছ কেটে ফেলার পর তা আর লাগানো হয় না। ফলে শহরটা একসময় কেবল কংক্রিটের জঞ্জাল হয়ে পরে থাকে। যেখানে গাছপালা নেই সেখানে কীট পতঙ্গ পাখি নেই, ফলে সেখানে প্রাণ নেই।
শহরের পরিণতি হয় ক্রমশ নিষ্প্রাণ। এই নিষ্প্রাণ শহর হওয়ার পরিণতি থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? কংক্রিটের জঞ্জাল সরিয়ে প্রচুর সবুজ বনায়ন করতে হবে। ঢাকার বাতাসও বিষাক্ত। প্রতিদিন সেখানে বসবাসরত মানুষ যে বাতাস দিয়ে ফুসফুস পূর্ণ করছে তাতে নানা ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। মিসরের কথাই ভাবুন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, মিসরের মরুভূমি এলাকায় খাড়া বন গড়ে তোলা হচ্ছে। এটা প্রথমবারের মতো। ভবনগুলোতে স্তরে স্তরে৩৫০ টি গাছ লাগানো হবে। শতাধিক প্রজাতির ১৪ হাজার গুল্মও লাগানো হবে। জনজট, যানজট ও বায়ুদুষণের কারণে মিসরের রাজধানী কায়রো মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ফলে নতুন এই এলাকাকে রাজধানী করা হবে। ইতালীয় স্থপতি এবং নগর পরিকল্পণাবিদ স্কেফানো বোয়েরি বলেন, মাত্র কয়েক শ বর্গমিটার এলাকায় কয়েক হাজার বর্গমিটারব্যাপী এই বন হবে। বনে পাখি ও পোকামাকড় থাকবে। এসব গাছ, গুল্ম কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করবে এবং অক্সিজেন ছাড়বে। একটা বিষয় ষ্পষ্ট, মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে, আবার শেষে সেই প্রকৃতির কোলেই ফিরে যেতে চাইছে। তাহলে উন্নয়নই যদি প্রথম থেকে পরিকল্পনামাফিক করা হতো তাহলে আজকে এই পরিণতি বরণ করতে হতো না। প্রকৃতি রক্ষা ব্যতীত যে আমাদের অস্তিত্ত থাকে না এই সহজ সত্যটি আমরা প্রথমে বুঝতে পারলেও বুঝতে চাইনি। আজ যখন বুঝতে পেরেছি তখন হয়তো অনেকটা দূরে সরে এসেছি। যদি এখই নিজেদের বাঁচাতে চাই তাহলে সবাই মিলে পরিবেশ রক্ষা করতেই হবে। তা রাজধানী হোক আর যেকোনো শহরই হোক। কারণ গ্রামগুলোও আজ আধুনিকতার নামে বিলাসিতার নামে গাছপালা উজাড় হয়ে দালাকোঠায় পূর্ণ হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের কার্যক্রম আজও থামেনি।
ঢাকার মানুষের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো দূষিত বায়ু। ডব্লিউএইচওর মানদন্ড অনুযায়ী, বিশে^র যেসব দেশের শতভাগ মানুষ মাত্রারিক্ত বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে তার একটি বাংলাদেশ। আর বলাই বাহুল্য যে আমাদের দেশের অন্য শহরের তুলনায় রাজধানীর বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি। ঢাকার বাতাসে মাত্রারিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে যা নিঃশ্বাসের সাথে দেহের অভ্যন্তরে পৌছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। একদিকে ইট কাঠের শহর থেকে গাছের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়া অন্যদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধিপাওয়া যানবাহনের ধোয়া, আশেপাশের ইটভাটার ধোয়া এসব মারাত্বকভাবে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের জন্ম দিচ্ছে। বায়ু দূষণের সাথে নোংরা এবং পানের অযোগ্য পানির কথা না বললেই নয়। ওয়াসার সাপ্লাই দেয়া পানি নিয়ে একজন সাধারণ নাগরিকের অভিনব প্রতিবাদের কথা গণমাধ্যমের কল্যাণে আজ সবারই জানা। এই ঘটনা কেবল একজন নাগরিকের ক্ষেত্রে নয় বরং এরকম নোংরা দুর্গন্ধ পানির অভিযোগ বহু। পানি মানুষের নিত্যদিনকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান। অথচ সেই পানির এর অবস্থা। এর কারণ ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোকে আমরা প্রায় মেরে ফেলেছি। যেখান থেকে আমাদের পানি সরবরাহ হয়। নিজেদের পেতে রাখা ফাঁদে আজ নিজেরাই। বোতলজাত পানি নিরাপদ মনে করার কোনো কারণ নেই। মাঝে মধ্যেই এসব বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের কীর্তিকলাপ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। মাটি দূষণের কথা বাদই দিলাম। কারণ দূষণ হওয়ার মতো মাটিই ঢাকায় অবশিষ্ট নেই। সব জায়গায় বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। পুকুর,জলা ভরাট করে এসব বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির হার সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। অধিকাংশ ভবনই ঝুঁকিতে রয়েছে। রাস্তায় বের হলেই মৃত্যু থাবা মেলে আছে জেনেও বের হতে হয়। এতসব সমস্যা নিয়ে রাজধানী কতদিন তার নাগরিকের কাছে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে থাকবে তা সময়ই বলে দেবে। ইতিমধ্যেই যান্ত্রিক শহরের খেতাব পেয়ে গেছে। মানুষই এখানে যন্ত্র। সেক্ষেত্রে রাজধানীর অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পণা এবং তার বাস্তবায়নের কোন বিকল্প আমাদের হাতে নেই।
একটি শহর ক্রমাগত দখল ও দূষণে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পরে। তার দায় সেই শহরের সকলের এবং বিশেষ ভাবে যারা এই শহরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় তাদের। সেখান থেকে ফেরাতে হলে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে কাজ করতে হবে। মৃত একটি শহর বাঁচাতে দায়িত্ব রয়েছে সবার। পরিচ্ছন্ন নগরী গড়তে প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন মানসিকতা। শহরটাকে নিজের ঘর মনে করতে হবে। নিজের ঘর আমরা যেভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখি, কোনোভাবেই নোংরা হতে দেই না সেই দৃষ্টিকোণ থেকে শহরকেও দেখতে হবে। শহর সুস্থ থাকলে সেই শহরের নাগরিকও সুস্থ থাকবে।
লেখক: শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক