স্কুলে পড়ার সময় প্রতি বছর ১৭ই মার্চ ও ১৫ই আগস্টে উপজেলা থেকে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। রচনার বিষয়বস্তু থাকতো ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’। শিরোনাম যা-ই হোক না কেন, লেখাগুলোর কেন্দ্রে ছিলেন আমাদের জাতির পিতা; স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। কোনো বছরই কাঁচা লেখার দরুণ পুরস্কার নিয়ে ঘরে ফেরা হতো না, তবুও আবার কবে সেই রচনা প্রতিযোগিতা ফিরে আসবে তার অপেক্ষা করতাম। বার বার একই জীবনী পড়ে প্রস্তুতি নেওয়ার ফলে একটা সময় দেখতে পেলাম, পিতার জীবন-কাব্য আমার মনে পোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। কারণ, জীবন একটাই। সেই জীবনের গল্পও একটাই। একবার সে গল্প তৈরি হয়ে গেলে আর তা মুছে ফেলা সম্ভব হয় না।
পুঁথিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবনের সাথে আমার এভাবেই পরিচয়। কিন্তু যে মানুষ আমার দেশের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি আমার স্বাধীনতার বীজ রোপণকারী, তার সাথে তো আমার পরিচয় আজন্মকালের। আমি যে আলোয় বেড়ে উঠেছি, সেই আলোর আদি দেহে তিনি মিশে আছেন; যে বাতাস আমার শরীর ছুঁয়ে যায়, সে বাতাসে তিনিও একদিন শ্বাস নিয়েছেন! কিন্তু তিনি ছিলেন আমাদের সবার চেয়ে অনেক বেশি ভিন্ন একজন মানুষ। ঠিক মানুষ হয়েও যেন মানুষ নয়। তার চেয়ে অনেক উপরে এই মহান ব্যক্তির অবস্থান।
ছাত্রজীবনে মিশে গেলেন জনমানুষের জীবনে। এরপরে আর সেই ¯্রােত থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। নিজের পুরো জীবন ¯্রােতের উপরে একখন্ড ভেলা ভাসিয়েই কাটিয়ে দিলেন। এই ভেলায় ভেসেই যে তাকে লাল-সবুজ পতাকার কাছে পৌঁছতে হবে, এই কথা সম্ভবত আমাদের দূরদর্শী পিতা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আপন সংসারের মায়া ত্যাগ করে, সমগ্র বাংলাকে আপন করে নিলেন। জীবনের চার হাজার ছয়শত বিরাশিটি দিন তিনি কারাবন্দি হয়ে পার করলেন। ১৪ বছর! সময়টা নেহায়েত কম নয়। এতগুলো দিন নিজের আত্মীয়-পরিজন, ব্যক্তিগত সুখ-আহ্লাদ থেকে দূরে থাকাৃ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কি অবদান ছিলো, সেই প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় এই চার হাজার ছয়শত বিরাশি দিন দিয়ে দেয়। এই দিনগুলোর মর্যাদা সৃষ্টিকর্তা জাতির পিতাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি কেন এত কম সময়? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হন, তখন তার বয়স মাত্র ৫৫বছর। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের আরো কয়েকটি বছর যদি তিনি স্বাধীন দেশের বুকে কাটাতে পারতেন, তাহলে হয়তো সত্যিই দেশটা সোনার বাংলা হয়ে উঠতো। অন্যরকম হতো আমাদের দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস!
শেখ মুজিবুর রহমান, এই মহান ব্যক্তির সংগ্রামী জীবনে সবচেয়ে স্পর্শকাতর কিংবা মন কেমন করা ঘটনা কোনটি ছিলো আমি ঠিক জানি না। তবে তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে যখন পড়ি, “একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে- হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?” তখন আমার মনে হয় একজন পিতার জীবনে এর চেয়ে বড় স্পর্শকাতর ঘটনা কি আর কিছু হতে পারে? সন্তানদের কাছে এভাবেই অচেনা মানুষ ছিলেন তিনি, তবুও কখনো নিজের দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসেননি। কারণ, তিনি দেশ-মাটি-মাকে ভালোবাসতেন। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিলো তার একমাত্র ধ্যান!
সাহসী-সংগ্রামী-ভালোবাসার এই মহান নেতাকে অজ¯্র শ্রদ্ধা জানাই।
এই বাংলার আকাশ- বাতাস, সাগর- গিরি ও নদী
ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি
হেরিতে এখনও মানবহৃদয়ে তোমার আসন পাতা
এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা-পিতা-বোন-ভ্রাতা।
-ডাকিছে তোমারে, সুফিয়া কামাল