বাঙালি জাতির ঐতিহ্যময় ও গৌরবের ভাষা বাংলা। এই বাংলাদেশ স্বাধীন করতে যেমন রক্ত আর জীবন দিয়েছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা, ঠিক তেমনি মাতৃভাষাটাও রক্ত আর জীবন দিয়ে পেয়েছি। এটা এমনি এমনি আসেনি। এটা অস্বীকার করারও কেউ নেই। ভাষার জন্য আন্দোলন করে জীবন উৎসর্গ করাটাও বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। একমাত্র বাঙালি জাঁতি পেরেছে এমন বিরল ইতিহাসের সাক্ষী হতে।
ভাষা আন্দোলন অর্থাৎ একুশে ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবজ্জ্বল একটি দিন। এটি আমাদের কাছে ঐতিহ্যময় শহীদ দিবস। বিগত ২১ বছর ধরে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত সারা বিশ্বে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায় বাঙালি জাতির জন্য এই দিনটি বাড়তি এক গর্ব বয়ে এনেছে।
১৯৫২ সালের এই দিনে ২১ ফেব্রম্নয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করে ছাত্ররা। সেদিন আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে তৎকালীন পাকিস্তানি পুলিশ। সেদিন ভাষার জন্য প্রাণ হারায় দেশপ্রেমিক তরুণ ছাত্ররা। মাতৃভাষার জন্য হয়েছে শহীদ। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে মহান মহিমায়।
১৯৯৮ সালে ক্যানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
এত কিছুর পরেও যেন আমরা প্রকৃত সুখ অনুভব করতে পারছি না। কারণ আজ আমরা বাংলা ভাষাকে ভুলে যাচ্ছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি 'অ আ ই এ ও ক গ ও ব ড ত' এসব বর্ণমালাকে। আমাদের ভাষা হয়ে গেছে আজ বাংলিশ। আমরা আজ ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে বাংলা লিখছি। কতটা বেদনা দায়ক এ বিষয়টি সেটা বাংলা ভাষাকে ভালো না বাসলে বুঝা মুশকিল। আমরা আমাদের কথায়েও আজকাল বাংলার সঙ্গে অনায়াসে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছি। যা আমাদের এখন নিত্যদিনের বিষয়। টেলিভিশনের খবর থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা কাজে আমরা এখন বাংলা ভাষার সঠিক মর্যাদা করি না। অথচ এই ভাষার জন্যই সালাম, রফিক, বরকতরা নিজেদের জীবন দিয়েছিল। তবে এটাই কি আমাদের প্রতিদান! এটাই কি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা? আসলে আজ আমরা সাজানো গোছানো সবকিছু পেয়ে ভুলে গেছি ইতিহাস। আমরা ভুলে গেছি এই ভাষা আর এই দেশের মূল্য কতখানি। কিন্তু কতদিন? কতদিন আমরা এই ভুলের বৃত্তে বসবাস করব। প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনাদের কাছেই আছে। আশা করি, নিজেকে নিজে উত্তরটা দিয়ে দেবেন।
আজকাল আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব স্থানে অনুষ্ঠানের সময় গান বাজানো হয় অন্য সংস্কৃতির। সেখানে থাকে হিন্দি আর ইংরেজি গান। অথচ আমাদের নিজেদের ভাষার গান থাকতে আমরা সেগুলো শুনি না।
আবার বাইরে লোক দেখানো দেশপ্রেম আমরা দেখাই। এখন বাংলা গান থাকলে সেখানে কেউ যায়ও না, কিন্তু হিন্দি গান চললে সেখানে দৌঁড়ায়। আবার তারাই ফেসবুকে একুশে ফেব্রম্নয়ারি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলিশে পোস্ট করে। আমরা প্রকৃত পক্ষে এমনই।
আর কতদিন! আর কতদিন আমরা এই মুখোশ নিয়ে বেঁচে থাকব? আসুন-না আজ থেকে আমরাও পরিবর্তন হই। জানতে চেষ্টা করি আমাদের ইতিহাস। তবেই দেশের প্রতি এবং নিজেদের ভাষার প্রতি সম্মান বাড়বে। তাই আসুন শুধু ভাষার মাস নয়, প্রতিটি মাস যেন বাংলা ভাষার মাস হয়ে থাকে আমাদের হৃদয়ে সেভাবেই চলি।
আজহার মাহমুদ : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক