নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। চলছে পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। যে পেঁয়াজ ২০ টাকা কেজি ছিল দু'তিন সপ্তাহের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ টাকা কেজি ধরে। পেঁয়াজ ছাড়াও অন্যান্য পণ্যর যে হারে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে এই মূল্যবৃদ্ধির গতিটাও অস্বাভাবিক। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে পরিমাণ দাম বাড়ছে কৃষিজাত পণ্যের তার সুফলটা মূল উৎপাদক অর্থাৎ কৃষক পাচ্ছেন না। কারণ, কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে ভোক্তার হাতে বিক্রি হয়- তাই মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষিজাতের পণ্যের উৎপাদনকারী কৃষকের কোনো ভূমিকা নেই। মূল্যবৃদ্ধির জন্য মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি। যেমন জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। ওয়াসার পানির দাম বেড়ে যাওয়াটাও অন্যান্য পণ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। সিলিন্ডার গ্যাস, ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে তার প্রভাবটাও পড়েছে অন্যান্য পণ্যের ওপর। দেশের মানুষের আয়ে সিলিংটাও অদ্ভুত- অর্থাৎ আয় বৈষম্যটাও মারাত্মক। তাই ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতাটাও অনেক সময় মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে। যার আয় বেশি তিনি যে কোনো পণ্য অধিক মূল্যে ক্রয় করতে পারেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের স্থান ৩০তম। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮২৯ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশ বর্তমানে যে ধরনের অর্থনীতির বিকাশের দিকে এগুচ্ছে, এই প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২৫টি অর্থনীতির দেশের তালিকায় চলে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জিডিপির আকারে বিশ্বের ৩০তম। অথচ এই দেশে খাদ্যপণ্য কেনার জন্য টিসিবির লাইনে যে হুড়োহুড়ি দেখা যায়, তা অবাক করার মতো দৃশ্য। কারণ একটি মধ্যম আয়ের পথে ধাবমান দেশে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ অর্থহীন থাকতে পারে না। যে দেশটির মাথা পিছু আয় প্রায় তিন হাজার ডলার। গড় আয়ের বিষয়টি বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় ভয়াবহ এক দৃশ্য। বাংলাদেশে ব্যক্তির শ্রমের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াটাও চরম বৈষম্যমূলক। যেমন, ঢাকা ওয়াসার এমডি ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে যোগদান করেন। এরপর থেকে তার বেতন ভাতা বেড়েছে ৪৩১ শতাংশ। তিনি বর্তমানে মাসে সর্বমোট ভাতা ও বেতন পান ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেই হিসাবে তার বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ৭৫ লাখ টাকা। ওয়াসার এমডির বেতন ডলারের কনভার্ট করলে দেখা যায় প্রায় ৯১ হাজার ৪ শত ৬৪ ডলার। মাথা পিছু আয়ের হিসাবে তিনি একাই ৩০ জনের অধিক আয় করেন। দেশের সাধারণ ৩০ জনের আয় যদি শূন্য থাকে আর সেই আয়গুলো ওয়াসার এমডির আয়ের সঙ্গে যোগ করে গড় করা হয়। তাহলে তো মাথা পিছু আয় ৩ হাজার ডলার হওয়াটা স্বাভাবিক। ওয়াসার এমডির মতো দেশের অনেক সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের বৈধ আয়ের আকার এ রকম। অবৈধ্য আয়ের বিষয়টি বাদই রইল। অন্যদিকে অবৈধ আয়ের পরিমাণটা যোগ করে হিসাবে করলে দেখা যাবে যে, সরকারি ত্রিশ লাখ কর্মীদের প্রতিজনেরই গড়ে ১০ থেকে ২৫ হাজার ডলার আয় করছেন। অন্যদিকে দেশের মুনাফালোভী সিন্ডিকেটধারী ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত আয়ের আকার সরকারি কর্মীদেরই মতো, ক্ষেত্র বিশেষ অনেক ব্যবসায়ীর আয় ওয়াসার এমডির প্রায় ৬ থেকে ১০ গুণেরও অধিক হবে। এসব ব্যক্তির আয়ের বৃহৎ অংশের জোগান দেয়ার জন্য বাড়ানো হয় পানি, বিদ্যুৎ, জ¦ালানি তেল, ভোজ্যতেল, গ্যাসের মূল্য। আর বাড়ে বিভিন্ন ধরনের কর। সরকার আরোপিত সব করের করাঘাতটা এসে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। তাই নিম্ন আয়ের মানুষ লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে দিশেহারা। ঢাকা শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক খরচের হিসাব একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তাতে যে হিসাবটি দেয়া আছে তা এ রকম, বাসা ভাড়া ১৬০০০ টাকা, সন্তানের লেখাপড়া বাবদ ৮০০০ টাকা, অফিস যাতায়ত ৩০০০, মায়ের ওষুধ ৮৫০, পত্রিকা বিল ১৫০, পানির বিল ৫০০, গ্যাসের বিল ৯৭৫, বিদ্যুৎ বিল ৮০০, ডিশ ইন্টারনেট ১১০০, ডিপিএস ১০০০, ময়লা ফেলা ১২৫, বুয়ার বেতন ২০০০ টাকা সর্বমোট মাসিক বাজার খরচ ৩৪৫০০ টাকা। ৫০ হাজার টাকার বেতনের ওই কর্মীটির বাকি অর্থ দিয়ে চাল-ডাল কাঁচাবাজাসহ অন্যান্য চাহিদা মিটিয়ে সংসার চালানো দুরূহ ব্যাপার। যদি ৫০ হাজার টাকা মাসে মাইনে পাওয়া ব্যক্তির অবস্থা এ ধরনের শোচনীয় হয়- তাহলে ওই ব্যক্তির বাসায় কর্মরত বুয়ার কথাটা একটু ভাবুন। বুয়া নামে এই গৃহকর্মীটি মাসে পাচ্ছেন ২০০০ টাকা। এ ধরনের গৃহকর্মীদের বলা হয় ছুটা বুয়া মানে এরা একাধিক বাড়িতে কাজ করেন। এরকম একজন ছুটা বুয়া তিন বাড়িতে কাজ করতে পারেন। তাহলে বুয়া নামের গৃহকর্মীটির মাসিক আয় মাত্র ৬ হাজার টাকা। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখের অধিক পোশাককর্মী রয়েছেন যাদের মাসিক আয় সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে। দেশের জিডিপিটি বৃহৎ কলেবরে পরিণত হচ্ছে এদেরই শ্রমে। দেশের প্রান্তিক কৃষকের আয়ের হিসাব করলে দেখা যায়, তারা মাসে গড়ে ৫ হাজার টাকাও আয় করতে পারেন না। দেশের প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। পঞ্চাশ হাজার টাকা মাসে আয় করা ব্যক্তির জীবনযাপন যদি দুসাধ্য হয়ে উঠে, তাহলে দেশের বুয়া নামের গৃহকর্মী, প্রান্তিক কৃষক, পোশাক শ্রমিকদের অবস্থার কথাটা একটু ভেবে দেখুন। দেশের নিত্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন হয়ে পড়ছে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির কারসাজির জন্য। দেশের মানুষের অভাব অনটনের কথা বলতে গেলে বর্তমান সরকার দলে আসা কিছু হাইব্রিড নেতাকর্মী, সমর্থক তাতে রাজনীতির প্রলেপ দেয়। গত কিছুদিন আগে টিসিবির ট্রাকের লাইনে হট্টগোল বিষয়টি বলায়, জনৈক হাইব্রিড দেশের প্রথম স্বৈর শাসকের আমলের সঙ্গে তুলনা দেন। দেশের বর্তমান অর্থনীতির আকার যত বড় হয়েছে তা ৫০ বছরের ইতিহাসকে হার মানায় অপরদিকে যে হারে আয় বৈষম্য বেড়েছে তাও ৫০ বছরের রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। যারা '৭৭-'৭৮ অর্থবছরের সঙ্গে বর্তমান অর্থনীতিকে তুলনা করছেন তাদের অর্থনীতি সম্পর্কে মৌলিক ধারনাটাই নেই। অথচ রাজনীতির প্রলেপের মাধমে তোষামোদকারীরা যা করছে তা সরকারের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কারণ এই তোষামোদকারী মুশতাকের আদর্শবাহী। এদেরই আগের প্রজন্ম জিয়ার স্বনির্ভর গ্রাম ব্যবস্থাকে জিন্দাবাদ জানাত। এখন তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম বর্তমান সরকারের গুণগানে বেহুশ। এদেরই দেখা গেছে, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে। কোনো কারণে সরকার যদি না থাকে এরাই আবার দোষ বলতে শুরু করবে। সরকারের ইতিবাচক সমালোচনা মঙ্গলজনক। অন্ধত্ব তোষামোদকারীরা সরকারের ভালো চায় না। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির কলেবরটা দিন দিন বাড়ছে আর সেই সঙ্গে বাড়ছে আয় বৈষম্য। আয়ের এ ধরনের বৈষম্য বাড়তে থাকলে একসময় ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করবে। এরকম আয় বৈষম্য রাষ্ট্রের আপামর জনগণের জন্য হিতকর নয়। আর আয় বৈষম্যের কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে- কারণ যাদের আয় বেশি তারা অধিক দামে পণ্য কিনেও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়- যার কু প্রভাবে নিম্ন আয়ের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
আয় বৈষম্য নিরসন করার লক্ষ্যে জাতীয় অর্থনীতিতে সমবণ্টন প্রক্রিয়ার দিকে যাওয়ার একটি নীতি তৈরি করা দরকার। তাহলে বিশ্বের শীর্ষ ২৫ ধনী দেশের তালিকায় ধাবিত বাংলাদেশের অর্থনীতির সুফলটা আপামর জনসাধারণ ভোগ করতে পারবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক