যানজট ঢাকা শহর সহ প্রতিটি শহরের একটি সাধারণ। এর মধ্যে রাজধানীর চিত্রই সবচেয়ে বেশি খারাপ। এখানে অবস্থা এমন যে গাড়িতে চড়েই মানুষ ধীরে যায়! যানজট এতটাই দুর্বিষহ করে তুলেছে নাগরিক জীবন। এর থেকে যেনো কোনোভাবেই রেহাই মিলছে না। ফলে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘন্টা এবং মূল্যবান সময়ের একটি অংশ কাটছে গাড়িতে অপেক্ষারত অবস্থায়। তাছাড়া দীর্ঘসময় যানজটে অপেক্ষার ফলে শরীর ও মনে ক্লান্তি ভর করছে। এতে কাজের প্রতিও খানিকটা অনীহা জন্মে। রাজধানীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে চারশত মানুষের বসবাস যা বিশে^র অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে রাজধানীতে প্রতিদিনিই চাপ থাকে। কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে জীবন ও জীবিকার তাগিদে এবং গুরুত্বপূর্ণ নানা কাজে। একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, প্রতিদিন ঢাকার আশপাশ থেকে ৫ লাখ মানুষ রাজধানীতে আসা-যাওয়া করে। আর বছরে ৫ লাখ মানুষ থাকতে আসে। ফলে শহরের চাপ ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ বৃদ্ধির ফলে পরিবহনের চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ যাতায়াতের জন্য মানুষ পরিবহণ ব্যবহার করছে। অথচ যে দ্রুততার জন্য বা একটু আরামের জন্য পরিবহণের ব্যবহার করছে সেখানে অপেক্ষা করছে ভোগান্তি। ফলে ব্যস্ত এই শহরে দিন-রাতের একটি বড় অংশই যানজটের কবলে পরছে। সেই ভোগান্তি ক্রমশই নাগরিক যন্ত্রণার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠছে। অথচ যানজট কমানোর জন্য বহু পন্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসার সময় যানজটের কবলে পরছে মানুষ। ঘন্টার পর ঘন্টা অপচয় হচ্ছে। অনেকেই আজকাল একটু দূর হলেও যানজটে পরার ভয়ে হেঁটেই কর্মক্ষেত্রে রওনা হচ্ছে। প্রতিদিন রাস্তায় বের হওয়া থেকে শুরু করে ঘরে ফেরা পর্যন্ত যতটা সময় রাস্তায় কাটানো হয় প্রায় প্রতিটি মুহূর্তেই যানজটের সমস্যায় ভোগান্তি পোহাতে হয়। যানজটের কারণে যে বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি করছে তার প্রতিটি হিসেব করা সম্ভব হয় না। যানজটে মানুষের যে ক্ষতি হয় তা কেবল সময়ের না, এর সাথে দেশের আর্থিক ক্ষতিও রয়েছে। কারণ এই যানজটে থাকার সময়টুকু সে কাজ করলে তার নিজের ও দেশের কাজে লাগতো। একসময় মানুষ দ্রুত যাওয়া আসার জন্য গাড়ি ব্যবহার করতো। এখন গাড়িতে উঠলেই মনে সন্দেহ হয় সঠিক সময়ে পৌছাতে পারবো তো? প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকামুখী হচ্ছে। জীবিকা ছাড়াও বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে মানুষ শহরে আসছে। ফলে প্রতিদিনই ঢাকা শহরের স্থায়ী মানুষের সাথে এরা যোগ হচ্ছে। বিশ^ ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় গড়ে প্রতি ঘন্টায় গণপরিবহনের গতিবেগ ১০ বছর আগে ছিল ২১ কিলোমিটার আর এখন ঘন্টায় তা নেমে এসেছে ৭ কিলোমিটারে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ রাজধানী ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে।
অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। সেই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাইরে বের হয়েই প্রথম যে সমস্যায় পরতে হয় তা হলো যানজট। ঢাকার মানুষ দৈনিক রাস্তায় চলতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করছে রাস্তায় গাড়িতে। প্রতিদিন যানজটে পরে ঢাকার মানুষের লাখ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এত কর্মঘন্টা নষ্ট হওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যানজট কেবল ঢাকার সমস্যা নয় বরং এশিয়ার কয়েকটি দেশ সহ অনেক বিশে^ই যানজট মারাত্বক সমস্যা হয়ে বসে আছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। যার যেভাবে খুশি বড়বড় বিল্ডিং তৈরি করে রেখেছে। রাস্তার ভেতর গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। গাড়ির চেয়ে যদি মানুষের হাঁটার গতি একসময় বেশি হয় তাহলে আর গাড়ির দরকার কি! তাহলে একসময় কি যানজটে শহরগুলো স্থবির হয়ে যাবে? যদি যানযট পরিস্থিতি বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ না করে তাহলে সত্যিই স্থবির হয়ে যাবে। তখন মানুষ হাঁটবে আর যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকবে। এখনই অবশ্য সেই অবস্থার কিছুটা আাঁচ পাওয়া যায়। যানজট নিরসনে বহুবার বহু উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যত তা ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে ঢাকার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দেখা যায় এক পরিবারে একটি গাড়ি হলেই চলছে, সেখানে একাধিক গাড়ি কিনে রাস্তায় নামাচ্ছে। এসব টাকার কুমিররা নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য জনগণের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহন, প্রাইভেট কার,মাইক্রো বাস মটরসাইকেল এসব যানবাহন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা যেন থমকে আছে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে কি হবে তা সময়ই বলে দেবে। ঢাকার যানজট বৃদ্ধির জন্য বাস্তবিকপক্ষে পারস্পরিক কয়েকটি বিষয় দায়ী। যানবাহনের সংখ্যা যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঢাকার রাস্তার অবস্থা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। ট্রাফিক সিগনাল আর দশটা সাধারণ আইনের মতই মেনে চলার তেমন কোন আগ্রহ নেই। তাই কয়েক বার ডিজিটাল ট্রাফিক সিগনাল চালু করেও সাফল্য পাওয় যায়নি। বাধ্য হয়েই ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় কঠোর হতে হয়। লোকাল বাসগুলো সবসময় একে অপরের সাথে প্রতিযোগীতা করে চলেছে। একবার জ্যাম তৈরি হলে তা আর যেন ছাড়ার নাম থাকে না। কারণ ততক্ষণে পেছনে শতশত গাড়ির বহর। ফলে খুব অল্প ভুলে এভাবে যানজট ভোগান্তি সৃষ্টি করছে।
যানজট নিরসনের জন্য ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি ফ্লাইওভার। রাজধানীতে মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো নতুন পরিকাঠামো নির্মাণ শেষ হলে যানজট কমে আসবে। তবে এই সুবিধা পেতে আরও সময় প্রয়োজন। ফ্লাইওভার তৈরি করেও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি সাধন হয়নি। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে বিকল্প যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সহজ ও সব জায়গায় পৌছে দিতে হবে যাতে দেশের প্রান্তিক জনগণও তা ব্যবহার করতে পারে। ফলে স্বস্তি ফিরবে আশা করি। শহরের ভেতরে গাড়ি চালানোর নিয়ম কানুনের কোন তোয়াক্কা করছে না চালকেরা। আর তোয়াক্কা করেই কি হবে! আইন না মেনেই যদি গাড়ি ইচ্ছামতো চালানো যায় তাহলে আইন মানার দরকার থাকে না। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভেতর আনতে হবে। একটি ছোট পরিবারের জন্য একটি গাড়ি থাকতে হবে। সড়ক পরিবহণ খাতের বিশৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। স্বল্প দুরত্বে সাইকেলের মতো যানবাহন জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এতে একদিকে যেমন যানজটের মাত্রা কমানো যাবে অন্যদিকে দূষণের মতো বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। প্রতি মাসে যে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেসব গাড়ি রাখার মতো জায়গা ঢাকায় নেই। ইতিমধ্যেই এই শহরের ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে। বলাই বাহুল্য এর বেশিরভাগই ব্যক্তিগত। কারো আরাম আয়েশের জন্য প্রতিনিয়ত কষ্ট পেতে হয় পাবলিক বাসে যাতায়াত করা মানুষগুলোকে। এ ছাড়া যে কারণে মানুষের রাজধানীমুখী চাপ বাড়ছে বা থাকে সেই কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। অর্থাৎ অন্য শহরগুলোতে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
মূলত যানজট নিরসনের জন্য দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা দরকার যা ঢাকা শহরের মতো একটি সমস্যাপূর্ণ শহরের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদী হলেও তা যেন কার্যকরী হয়। এর মধ্যে কয়েকটি উদ্যোগ বা পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। গোড়া থেকে সমস্যার সমাধান করতে হবে। কোনো সমস্যার আপাত সমাধান না করাই ভালো। এতে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়। ঢাকার বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবিকপক্ষে যেকোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। কারণ এর সাথে আইন মেনে চলার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। আর আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ বা চালক কেউ আইন মেনে চলতে ইচ্ছুক নই। বিশেষ করে যখন বড় বড় মানুষের গাড়ি উল্টো পথে চলতে গিয়ে রাস্তার মাঝে ভজঘট অবস্থা তৈরি করে তখন বেশ কষ্ট হয় এই ভেবে যে যাদের সাধারণ চালকেরা অনুকরণ করবে তারাই নিয়ম ভাঙছেন। সাধারণ মানুষ যখন তখন গাড়ির সামনে দিয়ে পার হচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও সে তা করছে। তাকে বাঁচাতে গাড়ি থামতেই যানজট তৈরি হচ্ছে। একজনের জন্য পেছনের গাড়িতে বসা হাজার হাজার মানুষের বিড়ম্বনার কারণ হওয়া যাবে না। যানজটের কারণে এই বিপুল কর্মঘন্টা নষ্ট এবং তার কারণে অপচয় সত্যি দুঃখজনক ঘটনা। যখন আমরা দেশকে উন্নত করার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছি। গাড়ির সংখ্যা এত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই শহরের সাথে তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ঠিক যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেভাবেই যেন গাড়ির সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ফলে সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করতে হবে। যানজটের ভোগান্তি থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে হবে।
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক