কোচ সম্প্রদায় শেরপুরে বসবাসরত ক্ষুদ্র
নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার
দূরে ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে রাংটিয়া এলাকায় রয়েছে কোচ
পল্লীর সারি সারি মাটির দালান। প্রতিটি কোচ বাড়িতে রয়েছে জবা, গোলাপসহ
দেশীয় ফুলের গাছ। বাড়িতে বাড়িতে রয়েছে ছোট আকৃতির মন্দিরও। এক সময়কার
প্রভাবশালী জনগোষ্ঠি কোচ সম্প্রদায়ের বসতি এলাকা এখন সীমিত হয়ে পড়েছে।
জনসংখ্যাও অনেক কমে গেছে। কোচ সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের রয়েছে নিজস্ব
ভাষা ও সংস্কৃতি। নববর্ষে এ সম্প্রদায় ‘বিহু’ উৎসব পালন ও বৈশাখি বাস্তু
পূজা করে থাকে।
শেরপুরে কোচপল্লীগুলোতে একসময় বিহু উৎসবের ঘিরে নানা আয়োজন হলেও এখন আর
তেমন চোখে পড়ে না। কোচদের ‘বিহু’ উৎসব ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক
উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোচদের এই বর্ষবরণ ‘বিহু’ উৎসব উপভোগের পাশাপাশি
আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী এবং ভিন্ন সম্প্রদায় ও
ভাষাভাষী মানুষেরা। কিন্তু আগ্রাসন, দারিদ্রতা আর অতিমাত্রায় কৃষি
নির্ভরতার কারণে ক্রমেই কোচরা সংকুচিত হয়ে আসছে। নানাভাবে জমি হারানোর
পাশাপাশি কোচদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি লুপ্ত হতে চলেছে। তাই
বৈচিত্রময় সমাজ গঠন এবং ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব
স্বত্তা ফিরিয়ে আনতে কোচদের নববর্ষ উৎসব ‘বিহু’ সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ
নেয়া প্রয়োজন।
গুরুচরণ-দুধনই আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক যুগল কিশোর কোচ বলেন,
‘ওই এলাকায় প্রায় শতাধিক ঘর কোচ পরিবার রয়েছে। পহেলা বৈশাখে তারা নববর্ষ
বা ‘বিহু’ পালন করে থাকেন। ইতোমধ্যে বাড়িতে বাড়িতে বিহু উৎসব পালনের জন্য
চালের গুড়া, শুটকি শুকানো, ঘরদোর পরিষ্কার করাসহ নানা প্রস্তুতি শুরু
হয়েছে। তবে একসময় আয়োজন করে কোচপল্লীগুলোতে ‘বিহু’ বা নববর্ষ উৎসব পালিত
হতো। এ উপলক্ষে ‘কচ কাহিনী’, ‘দেবী যুদ্ধ’, ‘থুবল মাগাইনি’, ‘লেওটানা’ ও
পালাগানের আসর বসতো। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কালো, মৃদঙ্গ, ঢোল, গঙ্গ, করতাল ও
বাঁশির বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচ আর গান হতো। রাতে খাবার পর পরিবারের
সবাই মিলে পাটি বিছিয়ে জমতো ‘ফেলাওনি’ বা আড্ডা। কিন্তু কালের বিবর্তনে
এসব আর দেখা যায় না। তিনি বলেন, ‘আমরা কোচরা সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও
আমাদের কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। কোচ সমাজ সাধারণত দেও-দেবতা ও
প্রকৃতি- পূজারি। আমাদের নববর্ষ বা বিহুতেও অদৃশ্য দেও বা ওই প্রকৃতি
পূজার প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া বিশেষ ধরনের খাবার-দাবার ও লোকাচার পালন করা
হয়ে থাকে। এখন বাড়ি বাড়ি বিহু’র আচারাদি হয়, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজন
করে ‘বিহু’ করা হয় না। এজন্য খরচ অনেক, পরিশ্রমও অনেক। তবে যদি
সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকতো, তাহলে হয়তোবা এটা আনুষ্ঠানিকভাবে করা
যেতো। এতে ঐতিহ্য টিকে থাকতো। অন্যরাও কোচদের জীবনাচার, লৌকিকতা ও
সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারতো’।
কোচ নেতা মুক্তিযোদ্ধা নবীন কোচ বলেন, ‘বিহুর দিনে সকল কোচ বাড়িতেই
ঐতিহ্যবাহী কাঁথামুড়ি পিঠা, মেরা, তেলের পিঠাসহ নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়।
সাথে থাকে ‘মেরা’। অতিথিদের আমরা পিঠা ও মেরা দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকি।
এদিন সবাই নতুন জামা-কাপড় পড়বেন। ভালো কাজ করবেন। কোনো ধরনের ভারী কাজ
করবেন না। বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও যাবেন না। একেবারে বাধ্য না হলে কোনো
ধরনের যানবাহনে চড়বেন না। কোচ নারীরা তাদের এহিত্যবাহী পোষাক নতুন
‘লেফেন’ পড়বেন। নতুন জামা-কাপড় পড়ে কোচ পুরুষ-নারীরা নিকটাত্মীয়দের
বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। আনন্দ-উৎসব করে ‘কাঁথামুড়ি’ পিঠাসহ অন্যান্য পিঠা
খাবেন এবং ‘মেরা’ পান করবেন। এভাবেই সারাদিন কাটাবেন। সংশ্লিষ্টরা জানায়,
প্রতিটি কোচ বাড়িতেই রয়েছে ছোট্ট আকারের ‘কানিওয়াই’ দেবতার মন্দির। এটাকে
কেউ কেউ ‘পদ্মা মন্দির’ বলে থাকেন। কোচের বিশ্বাস এই দেবতা সর্বদা তাদের
অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা করে থাকে। প্রতিদিন সকালে ফুলপাতা, ধুপ-আরতি দিয়ে
কোচ পরিবারগুলো বাড়ির এ ‘কানিওয়াই’ দেবতার মন্দিরে পূজা দিয়ে দিনের
কাজকর্ম শুরু করেন। নববর্ষ বা বিহুর দিনও ঘুম থেকে ওঠে বাড়ির বউ-ঝিরা
ঘরদোর পরিষ্কার করেন, লেপা-মোছা করার পর গোসল করেন। তারপর ‘কানিওয়াই’ বা
পদ্মার মন্দিরে ধুপ-দোনা, ফুল দিয়ে পূজা করে দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা
করেন। এরপর অন্যান্য কাজ করেন। নববর্ষ বা বিহুর দিন কোচ পরিবারগুলো
সকাল-সন্ধ্যায় আরও দুটি বিশেষ পূজা করে থাকেন। সকালে করেন ‘হাজংবড়ি ওয়াই’
পূজা। এটি অনুষ্ঠিত হয় গাছতলায়। কোচদের বিশ্বাস, এ পূজা করলে কাজ করতে
গিয়ে দা-কুড়ালের আঘাত কিংবা যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ক্ষতি
হবে না। হাজংবড়ি ওয়াই দেবতা সর্বদা তাদের রক্ষা করবেন। আর এদিন সন্ধ্যায়
তারা করেন ‘গাসুম ওয়াই’ পূজা। এ পূজাটি করা হয় ঘরের ভেতর। কোচদের
বিশ্বাসমতে, এ পূজা করলে জীব-জন্তুর আক্রমণ থেকে এবং হিং¯্র প্রাণীর হাত
থেকে তারা রক্ষা পাবেন। এ দু’টি পূজার জন্য একজোড়া মুরগি বলি দিতে হয়।
সকালে পূজার সময় একটি এবং সন্ধ্যায় আরেকটি মুরগি বলি দেয়া ছাড়া ‘হাজংবড়ি
ওয়াই’ এবং ‘গাসুম ওয়াই’ পূজা হবে না। বিহুর দিনে এ দু’টি পূজা করলে
সারাবছর তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে সকল প্রকার বিপদ-আপদ ও জীবজন্তুর আক্রমণ
থেকে নিরাপদ থাকবেন বলে বিশ্বাস করেন।
রাংটিয়া গ্রামের সুরবালি কোচ বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি বছরের প্রথম দিনটি
যদি ভালোভাবে কাটে, তাহলে সারাবছর ভালো যাবে। এজন্য নববর্ষ বা বিহুর দিন
পূজাপালির বাইরে আনন্দ করে কাটাতে চেষ্টা করি। প্রতিবার বিহুর সময় বাবার
বাড়ি যাই। ওইদিন গাড়িতে না চড়ে হেঁটেই যাওয়া-আসা করি।