Finland is the biggest nanny state in the EU খ্যাত এই ন্যানি স্টেট হলো ফিনল্যান্ড। এ দেশে এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে জন্মের আগে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্রই তাদের নাগরিকদের দেখ ভাল করতে থাকে। সন্তান জন্মের আগেই ফিনিশ সরকার সমস্ত হবু মা বাবাদের এই ধরনের একটা বেবি বক্স পাঠিয়ে দেয়। এতে একবছর পর্যন্ত বাচ্চার যা যা দরকার তার প্রায় সব কিছুই থাকে। তাছাড়া সন্তান জন্মের পর ভীষন উন্নত মানের ক্রেশ এর সুবিধাও প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যায়। সেই জন্য স্কুল শুরু করার আগেই ফিনিশ বাচ্চারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে একদম তরতাজা অবস্থায় থাকে। এইবার স্কুল চলাকালীন বাচ্চারা যাতে আনন্দের সাথে পড়াশোনা করতে পারে, সেই দিকেও কড়া নজর রাখা হয়। একদিকে যেমন সরকারি অর্থায়নে প্রাথমিক শ্রেণী থেকেই উঁচু বেতনে খুব ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, অন্যদিকে পড়ার পাশাপাশি খেলাধুলোর জন্যেও প্রচুর সময় দেওয়া হয়। তাছাড়া হোমওয়ার্ক তো দেওয়াই হয় না, আর খুব দরকার না থাকলে বেশির ভাগ ক্লাসে পরীক্ষাও নেওয়া হয় না।
বাংলাদেশে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মী হিসেবে বলতে পারি যে, জাতিকে কখনোই কোন সরকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর থেকে গত অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যর্থতায় অগ্রসর হচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতার রক্ত দিয়ে অর্জিত লাল সবুজের দেশে। শিক্ষা খাতটি সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হয়েছে বারবার। এখন যদি প্রশ্ন ওঠে বাংলাদেশে শিক্ষার অবস্থা ভালো নয়, তাহলে কোন দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা সব থেকে ভালো? এর উত্তর অবশ্য চট করে ফিতে দিয়ে মেপে বলা না গেলেও Programme for International Student Assessment -এর তথ্যানুসারে বলা যায়- ফিনল্যান্ড এর শিক্ষা ব্যাবস্থাকে অন্যতম সেরা তো বলাই যায়। ১৮ কোটি মানুষের দেশে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেটের মাত্র ১৫ ছুঁই ছুঁই বরাদ্দ হলেও মাত্র ৫৫ লক্ষ জনসংখ্যার ফিনল্যান্ডে বাজেটের ৩০ ভাগেরও বেশি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। ফিনল্যান্ডের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনেকটাই অন্যরকম। যাকে অনেকে আদর করে) ন্যানি স্টেট বলে থাকলেও এই ন্যানি স্টেটই দেখিয়েছে আলোর পথ ভালোর পথ তার দেশের নাগরিকদেরকে।
শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনার সূত্র ধরে ফিনল্যান্ডকে নিয়ে আলেঅচনা করলেও বাস্তবতা হলো এই যে, সিঙ্গাপুর কিন্তু ইদানিংকালে ফিনল্যান্ডকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সেরাদের দেশ সিঙ্গাপুর। শিক্ষার্থীদের জন্যে আছে আশ্চর্য এক ইসকুল, যেখানে লুকোনো ক্যামেরায় ধরা হয় শুধুই ভালোর ছবি। শাস্তি নেই, আছে শুধু সম্মান আর আদর। সরকারি অর্থায়নে আদর্শ-শিক্ষিত সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে সুগঠিত পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় শিক্ষাঙ্গনের ক্লাসের সব ডেস্কের থেকে দূরে, আলাদা করে রাখা একটা ডেস্ক। এমন জায়গায়, যেখানে বসলে ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ারই সুযোগ নেই, কথা বলার সুযোগ দূরস্থান। স্কুলের প্রিন্সিপাল ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন সেই ক্লাসঘর। জানতে চাইলাম, নিশ্চয়ই খুব দুষ্টু ছেলেদের জন্য এই ব্যবস্থা? মধ্য চল্লিশের ভদ্রমহিলা হাসলেন। বললেন, এই স্কুলের সবাই তো দুষ্টু ছেলে। এই চেয়ারটা তাদের জন্য, যাদের বাড়িতে আজ কোনও একটা অশান্তি হয়েছে। সেই অশান্তির জন্য তার মন খারাপ। স্কুলে এসে এই চেয়ারে বসে পড়লেই অন্যরা বুঝতে পারে, তার আজ মন খারাপ। টিচাররাও বুঝতে পারেন। যে এই চেয়ারে এসে বসে, তাকে সবাই সেদিনের জন্য ছেড়ে দেয়। তার সঙ্গে কেউ ঝগড়া করে না, পড়া ধরে না। আর আমাদের দেশে শিক্ষার জন্য ভিক্ষা করতে হয় একটি মেধাবী শ্রেণিকে। স্মরণাপন্ন হতে হয় আমাদের সমাজের কথাকথিত উচ্চবিত্ত আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের রক্তচোষাদের। একদিকে কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে উপার্জন করে যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো, অন্যদিকে তাদের পক্ষ থেকে কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীকে সহায়তার নামে নেয় আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের প্রচার সহায়তা। তার উপর আছে ছাত্র শিবির-ছাত্রলীগের পাশাপাশি স্বাধীনতা আর ধর্মব্যবসায়ীদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদেরকে দলীয় কাজে ব্যবহারের লক্ষে তথাকথিত আর্থিক সহায়তার নাটক মঞ্চস্থ করতে ব্যর্থ! কিন্তু তা তো হওয়ার কথা ছিলো না। কথা ছিলো দেশ স্বাধীন হলে শিক্ষাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে শিক্ষাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি; হয়নি নীতি-আদর্শ প্রতিষ্ঠাও।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর এসেও দেখা যাচ্ছে- যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন সেই সরকারই ভুলে যায়- একটি দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের শীর্ষে নিতে হলে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার খুবি প্রয়োজন। মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারলে একটি জাতি খুবই দ্রুত অগ্রসর হয়। বিশ্ব শিক্ষায় এক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কিছু দেশ। আজ উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিন্নতা নিয়ে শিক্ষাপিডিয়া পাঠকদের জন্য কিছু তথ্য দেয়া হলো- পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার শিক্ষাব্যবস্থা দেশগুলোর মধ্যে প্রধানতম হল ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। বাস্তব ও বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ফিনল্যান্ড। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশটির বিশ্বসেরা হওয়ার দৌড়ে কাজ করছে গেমিং এডুকেশন বা খেলার মাধ্যমে শিক্ষা পদ্ধতি। নেই কোন পাঠ্যপুস্তকের ঝামেলা নেই কোন পরীক্ষার বালাই। ১৬ বছর বয়সে গিয়ে মাত্র একটি বাধ্যতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। দুপুরের খাবার, টিফিন, বই-খাতা, স্টেশনারি, শিক্ষাসফর এমনকি স্কুলে যাতায়াত সবকিছু বিনামূল্যে শিক্ষার্থীরা পেয়ে থাকে। শিক্ষাসংক্রান্ত সমস্ত খরচ সরকার বা রাষ্ট্র বহন করে থাকে।
উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম। সেই দেশে পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বোর্ডের পরীক্ষা কর্মকর্তারাই গ্রহণ করে থাকেন। এ ব্যাপারে কোনোভাবেই শিক্ষকদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি একটি স্কুল একাধিক বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষা দিতে পারে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান এর যে বোর্ড কে ভালো লাগে তারা সেই বোর্ডের অধীনেই পরীক্ষায় অংশ নেয়। এতে বোর্ড গুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে। ফলে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কোন সুযোগ থাকেনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের পুননির্মান ও বাণিজ্যিক সাফল্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে শিক্ষা। জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয় আর জুনিয়র হাইস্কুল হচ্ছে বাধ্যতামূলক শিক্ষার পর্যায়। জাপানি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন অনুসারে তৈরি ‘’ল’’ এর ভিত্তিতে পরিচালিত হয় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশটিতে কোনো শিক্ষাবোর্ড ও নেই।
স্কুল পর্যায়ে সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থা এতটাই ভাল যে, এখন তাদের অনুসরণ করছে পশ্চিমা দেশগুলো। ক্লাসের শিক্ষায় তাদের প্রতিদিনের জ্ঞান অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। পরীক্ষা নিয়ে তেমন চাপ নেই। তবে বিজ্ঞান রিডিং ও গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মান যাচাইয়ের পদ্ধতি হচ্ছে “পিসা”। শুধু এই পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নেয়া হয়। সেজন্য কিছুটা বাড়তি চাপে থাকে শিক্ষার্থীরা।
ইউরোপে সুপরিচিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে জার্মানির সুখ্যাতি রয়েছে। জার্মান শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় উচ্চমানের। আইনগতভাবে, জার্মান প্রতিটি শিশুর রয়েছে শিক্ষার ওপর সমানাধিকার ৷ তা সে কোনো অভিবাসী পরিবারের শিশু হোক বা কোনো ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ শিশু, আইন সবার জন্যই সমান ৷ তাদের স্কুলগুলিতে কারিগরি ও সৃজনশীল শিক্ষার উপরে নজর দেওয়া হয়। সেজন্য প্রচুর পরীক্ষা দিতে হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় বছরে একবার মাত্র পরীক্ষা নেয়া হয়। যেখানে শিক্ষার্থী কত নম্বর পেল তা নয় বরং দেখা হয় তার সৃজনশীলতা। এমন নিপুন শিক্ষা ব্যবস্থার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা লোভ মোহহীন নিরন্তর সমৃদ্ধ দেশে শিক্ষা খাতকে দিয়েছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। মূল বাজেটের সর্বোচ্চ আন্তরিক অংশটি শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ থাকে। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয়েছে বছরের পর বছর।
আমরা যদি দেশকে ভালোবাসি, শিক্ষাকে কেন নয়? কেন ভালোবাসেননি আমাদের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় আসা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী-সচিবসহ সংশ্লিষ্টগণ। যদি ভালোবাসতেন, তাহলে ‘জাতীয় শিক্ষাধারার বারবার দাবি ২৫ ভাগ বাজেট বরাদ্দ শিক্ষা খাতে দেয়া’র কথা আমলে না নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হতো না- ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। যেখানে সৌদি আরবের মত দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা একমূখি, সেখানে নির্মমতার শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা বহুমূখি। আর একারণেই সুশিক্ষার পরিবর্তে শিক্ষা ব্যবস্থা ভাগ হয়েছে বিভিন্নভাগে। আর সেই বিভিন্নভাগের শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে দুর্নীতি যেমন বেড়েছে, বেড়েছে লুটপাটও। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ ১৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ হাজার ২২ কোটি টাকা। করোনা অতিমারির ধাক্কা দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ প্রতিটি খাতকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা থেকে মুক্তি আনতে প্রয়োজন নীতি-আদর্শ-শিক্ষার আলোয় আলোকিত শিক্ষা মন্ত্রী-সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে শিক্ষা অধিকার প্রতিষ্ঠার মত ঋদ্ধ বাজেট পাশ ও বাস্তবায়ন করলেই আর ‘ভিক্ষা করে শিক্ষা’ অর্জনের চেষ্টা করতে হবে না দেশের অসংখ্য মেধাবীকে। কর্পোরেট হাউজগুলোর রক্তচোষা টাকায় যেন নিপুন মেধাবীদেরকে শিক্ষা অর্জনের জন্য স্মরণাপন্ন না হতে হয়; এজন্য চাই উন্নত দেশগুলোর মত পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা। যেখানে সকল শিক্ষার্থী তাঁর মেধার আলোয় আলোকিত হবে সরকারি অর্থায়নে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি।