মুসলিম জাতীর জীবনে ঈদ বহুল তাৎপর্যপূর্ণ একটি উৎসব। ঈদ মানে খুশি। প্রতি বছর মুসলমানদের জীবনে ঈদ বয়ে আনে খুশির বারতা। ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহা এ দুই ঈদ মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব। পৃথিবীর সব মুসলিমজাতি ঈদের দিন গুলো মহা আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকেন।
ঈদের দিন মানুষ তাদের সাধ্যামতো ভালো ভালো পোশাক পরেন এবং ভালো ও উৎকৃষ্ট মানের মুখোরচক খাবার তৈরী করে খায়। ধণি-দরিদ্র সবাই এ দিনটিকে মর্যাদার সঙ্গে এবং আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকেন। ঈদ এমনই একটি ধর্মীয় উৎসব, যে উৎসবের আনন্দে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই অংশীদার হয়ে থাকেন। এদিন ঈদগাহে সবার সম্মিলিত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু এবং সমাপ্ত হয়। দুই রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করার পর সমস্ত দিনই মানুষ আনন্দ-উল্লাসের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করে। ঈদের নামাজের পর মুসলমানেরা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময় করে থাকেন। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সমাজের সামর্থবান ব্যক্তিরা দরিদ্র মানুষের জন্য নির্দিষ্ট হারে ফিতরা বিতরণ করে থাকে।
ঈদ সবার জন্য আনন্দে বারতা বয়ে নিয়ে এলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ভিন্নতাও রয়েছে। বুকের বেতরের চাপা কিছু কষ্ট ঈদের আনন্দকে ম্লান করে সামনে ভেসে আসে কষ্টগুলো। ছোট বেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম, “আজ ঈদ মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে ছেলে-মেয়েদের কলরব। নবীজি দেখলেন ঈদগাহের পাশে একটি ছেলে বসে কাঁদছে। নবীজি ছেলেটির কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বল্লেন, কি হয়েছে বাবা, তুমি কাঁদছো কেনো? ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বল্লো, তার মা-বাবা নেই। নবীজি তাকে আদর করে খাওয়ালেন, নতুন জামা পড়ালোন”।
বেশ কয়েক বছর যাবৎ ঈদ এলেই আমার চোখের কোনে পানি জমে। জনমদঃুখিনী মা আর সরলসহজ বাবার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে ছোট সেই বোনটার কথা। যে আরো বাইশ বছর পূর্বে আমাদেরকে ছেড়ে মহান আল্লাহর ডাকে সারাদিয়ে পরোপারে চলে গেছে। একমাত্র ছোট বোনের মৃত্যুর পর থেকেই ঈদ আমাদের সংসারে কিছুটা দুঃখের অনুভুতি বইয়ে আনতো। কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০০০ সালের ২৮ আগষ্ট বোনকে হারানোর পর থেকে ঈদের দিন ফজর নামাজের জায়নামাজে বসে আমার জনমদুঃখিনী মায়ের কান্নায় আমাদের সবার মন বেদনার চাঁদরে আচ্ছাদিত হতো। এভাবেই কেটে আসছিলো আমাদের ঈদের দিনগুলো। ২০১৯ সালের ১লা জুন আবার আমার প্রিয় বাবা আমাদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আল্লাহর ডাকে সারাদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। আমার আব্বা এবং ছোট বোনের চলে যাওয়ার কষ্ট সইতে না পেরে ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্ব আমার জনমদুঃখিনী মা ও চলে যান দুর আকাশে গাঁয়। এখন আমি আর আমার একমাত্র ছোট ভাই আতা রাব্বী জুয়েল ধু-ধু মরুর সাগরে কেবলই এতিম, অসহায়। মনে পড়ে, ঈদ এলে আব্বা নিজের জন্য কিছু না কিনে আমাদের তিন ভাই বোনদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতেন। মা নিজে না খেয়ে সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত আমাদের জন্য ভালো ভালো খাবারের আয়োজন করতেন। একমাত্র ছোট বোনটি আমার নতুন জামা-কাপড় পড়ে রঙ্গিন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে ঘুরে বেড়াতো। সেই আনন্দ মিলিয়ে গেছে, সেই যে কবে, জানি না।
আল্লাহর অশেষ কৃপায় এখন আমার আর আমার ভাইয়ের সংসারে নতুন নতুন প্রজাপতিদের আগমনে ঈদ উৎযাপনের অন্য এক রকম অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছে। সহধর্মিনী ফৌজিয়া আক্তার মিতুর কোলজুড়ে আগমন ঘটেছে কন্যা ফাহমিদ তৃপ্তি ও পুত্র ফাহমিদ হাসানের। তাদের আনন্দ আমাকে আনন্দিত করে। তাদের আবেগ ও আনন্দে আমি সুখ পেতে চেষ্টা করি। হয়তো আমার মতো মা-বাবা ছাড়া এমন এতিম সন্তানেরা তাদের সন্তানদের মধ্যেই আবার সুখ খোঁজে বেড়ায়।
ঈদ উৎসবের সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও রমজানুল মোবারক পালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা উদযাপনের যে ইতিহাস জানা যায় তাতে ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে নামাজ, রোজা ও ঈদ উৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশ আগে থেকেই। বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। অপরদিকে আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব পূর্ব-বাংলায় স্থাপিত হয়। গ্লানীকে ভুলে ঈদ হোক সবার জন্য আনন্দের।
ফজলে রাব্বী সোহেল
সহ-সভাপতি, সোনারগাঁও প্রেস ক্লাব।