আধিপত্য নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে বছরের পর বছর ধরে দ্বন্দ চলে আসছে একটি ইউনিয়নে। এ ইউনিয়নেই দেশের বাঘা বাঘা চরমপন্থি আর সন্ত্রাসীর ঘাঁটি ছিল একসময়। রক্ত ঝরেছে বারবার। চরমপন্থিদের স্বার্থগত বিরোধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে একের পর এক হত্যা খুম,খুন চাদা বাজি অপহরোন সামাজিক কাইজায় লাশ পড়ছে ঝাউদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। দুই পক্ষের দ্বন্দে সমর্থক ও কর্মীসহ প্রান হারিয়েছে ৮৪ জন।
৮০দশকে এক পক্ষের নেতৃত্ব দেন বাখইল গ্রামের আবু তালেব মাষ্টার এবং অন্য পক্ষের নেতৃত্ব দেন আস্তানগর গ্রামের আজিজুল ম-ল। তাদের সন্ত্রছায়ায় কিছু সশস্ত্র লোকজন ইউনিয়নে ঘাঁটি গাড়ে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে অনেকেই তবে বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি তারা। গণবাহিনীর লোকজন এলাকার নিরীহ লোকজনকে মারধর, চাঁদাবাজি ও হত্যার মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে সামাজিক বিরোধ শুরু হয় দিনের পর দিন। এক গোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর লোকজনের বিরোধ দেখা দেয়। এভাবেই সংঘর্ষে রূপ নিতে থাকে। গণবাহিনীকে মোকাবেলা করতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান হয়। এ দলে যোগ দেয় এলাকার নির্যাতিত অনেক মানুষ। এরপর শুরু হয় উভয় পক্ষের অস্ত্রের ঝনঝনানি। ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত এই ইউনিয়নে খুন হয়েছে জনপ্রতিনিধিসহ প্রায় ৭৩ জন। এরপর পরের বছরে খুন হয়েছে ৫জন। ২০১৭সালে খুন হয় ২জন। ২০১৫সালে ২৪ সেপ্টেম্বরে দলের কোন্দলে মাছপাড়ার কৃষক ইমান আলী ও বৈদ্যনাথপুর গ্রামের শাহাজ উদ্দিনকে গুলি ও কুপিয়ে খুন করা হয়। খুনের সময় মজিদ মেম্বার নিজে উপস্থিত থেকে গুলি করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্েেয কেরামতের চাচাও ছিলেন। সেই সময় ইবি থানায় ১১০ জনকে আসামি করে মামলা হয় পুলিশ মজিদকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে এবং বখতিয়ারকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। খুন থেকে বাচতে সেই সময় চরমপন্থি নেতা মজিদ, বখতিয়ার আওয়ামী লীগ নেতাকে ম্যানেজ করেন, একই ভাবে কেরামতও এলাকায় নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে নেতাদের ম্যানেজ করেন। তবে জামিনে বের হওয়ার পর তারা এলাকায় ফিরে গিয়ে সব ধরনের ঝামেলা থেকে দূরে থাকার অঙ্গীকার করেন। ওই নেতাদের সেই সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সদর আসনের এমপি মাহবুবউল আলম হানিফের বাসায় ডেকে সমঝোতা করে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা ঝাউদিয়া ইউনিয়ন পরিষদে ওই নেতাদের হাত এক করে দেন। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। দুই নেতার পুরনো বিরোধ থেকেই ২০১৭সালে জীবন দিতে হলো বখতিয়ারের শ্যালক এনামুল ও কেরামতের সমর্থক বিল্লালকে।
কেরামত আলী সেই সময় সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও বখতিয়ার হোসেন ঝাউদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। বখতিয়ার একসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় নেতা ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় আসেন তিনি। দলে যোগ দিয়ে পদও পান। এরপর নির্বাচিত হন চেয়ারম্যান। কেরামত গণবাহিনীর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তিনি গণবাহিনীর অস্ত্রধারীদের শেল্টার দেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
২০২২সালের ২ মে- মাসে নতুন করে সংঘাতের কারণ জানতে চাইলে এলাকাবাসী বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও 'সাবেক চেয়ারম্যান কেরামত ও ফজুল মন্ডল সমর্থক বর্তমান চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান সমর্থকরাও গোষ্ঠিগত দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি গ্রামেই দুই নেতার সমর্থক আছে। এরপর আধিপত্য বিস্তার ও পুরনো বিরোধের প্রতিশোধ নিতেই নতুন করে খুনোখুনি শুরু হয়েছে।'এলাকার কয়েকটি হাট, ঠিকাদারি কাজ আর বিলের দখল ঠিক রাখতে এই সংঘাত। কোরামত চেয়ারম্যান থাকাকালীন এই ইউনিয়নে খুন হয়েছেন ৬জন তারা হলেন, ইউনিয়নের মাছপাড়া মার্ডার হন ঈমান, সাহাজদ্দিন আকামদ্দিন, ২০১৬ সাল যার মামলা নং ৭৩ ই বি জি, অপর দিকে বাখইল গ্রামে ৩ টি মার্ডার ইনামুল, শাহানুর ,বিল্লাল ২০১৭ সাল মামলা ১১২ নং ই বি জি
ইউনিয়নে চেয়ারম্যানসহ খুনের মিশন
স্বাধীনতার পর ঝাউদিয়া ইউনিয়নে প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন হাসান আলী। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। মেয়াদ শেষের তার প্রতি অনাস্থা আনা হয়। সেখানে দায়িত্ব নেন বাদশা মিয়া। এরপর ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব নেন ওয়ারেশ আলী বিশ্বাস। তিনি দায়িত্ব ছাড়লে ১৯৭৭ সালে নির্বাচিত হন আলী আকবার। এরপর আবারও দায়িত্ব পান হাসান আলী। ১৯৮৩ সালে নির্বাচনে চেয়ারম্যান হন ওয়ারেশ আলী বিশ্বাস। এরপর দুইবার চেয়ারম্যান হন আব্দুল আজিজ।
আবার পরের নির্বাচনে ১৯৯২ সালে নির্বাচিত হন ডা. আব্দুল আজিজ। এ সময়ে এলাকার অবস্থা উত্তপ্ত হতে থাকে। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি সুগ্রিবপুর শশুরের দাফন করতে গিয়ে শশুরালয় চেয়ারম্যান ডা. আব্দুল আজিজকে খুন করা হয়। তাকে হত্যা করার মাধ্যমে এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান খুনের মিশন শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের দিকে আবারও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলী আকবার।
এর পর এলাকায় জাসদের একক আধিপত্য বিস্তার হয়। এরপর ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন আলী আকবর। তিনি ১৯৯৯ সালের ১৭ জানুয়ারি কুষ্টিয়া উপজেলার সামনে খুন হন। এরপর উপনির্বাচনে জাসদের আঞ্চলিক কমান্ডার আজিবর মেম্বারের বড় ভাই খয়বার রহমান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাকেও ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরেই কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় সামাজিক দ্বন্দ্বে। একই দিনে হত্যাকারীদের পাঁচজনকেও পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী।
খয়বার নিহত হওয়ার পরে আজিবর নিজেই ২০০৩ সালের নির্বাচনে দাঁড়ায় এবং অস্ত্রের মুখে জয়লাভ করে। কিন্তু এ সময়ে এলাকায় কমুউনিস্টের প্রভাব বাড়তে থাকায় ভয়ে ঝাউদিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড মেম্বার মিজানুর রহমানের নিকট দায়িত্ব দিয়ে ভারতে পালায় এবং সেখানে নিজ দলের কন্দোলে খুন হয়। আজিবরের ভাই দুলালও খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে ঐ পরিবারের তিন ভায়ের গল্প শেষ হয়ে যায়।
চারজন চেয়ারম্যান ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ইউনিয়নে খুন হয়েছে আস্তানগরের আজিজুল মন্ডল খুন হন সন্ত্রাসীর গুলিতে, বাখইলের পলান মন্ডল, ছলিমদ্দিন কাইজায়, উদয় পুরের আফতাব মেম্বার, মঞ্জু, গুলিতে, বাখইল গ্রামের মজিদ খুন হন সন্ত্রাসীর গুলিতে, আজাদ, ঝাউদিয়ার আব্দুল হালিম, হাতিয়ার মাখা জর্দার, মাছপাড়ার আক্কাস সর্দার, ছামছুদ্দিন,রহিম, রাজ্জাক, ফজু ফকির, ফিরোজ এলামুল বেলাল, সহ ৮৪ জন। এছাড়াও গুম হয়েছেন লালন,কপিল,হাসিবুল,আলী,নুরাল,কালুসহ অনেকেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে ফজলু,আজাদ,মান্দার,মোহাম্মদ। এসব কারণে এলাকা ছেড়ে প্রায় শতাধিক পরিবার পাড়ি জমিয়েছে অন্যস্থানে। সর্বশেষ সোমবার (৩ মে২০২২) বিকেলে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের আস্তানগরে সামাজিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঝাউদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান কেরামত উল্লাহ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক ইউপি সদস্য ফজলু মন্ডল গ্রুপের সংঘর্ষে ফজলু মন্ডলের ছোট ভাই কাশেম মন্ডল, ভাতিজা লাল্টু মন্ডল ও মতিয়ার মন্ডল এবং কেরামত উল্লাহ সমর্থিত রহিম মালিথা খুন হয়। এই ঘটনায় ২০ আহত হয়েছে। মঙ্গলবার (৩ মে-২০২২) রাতে সংঘর্ষে নিহত মতিয়ার মন্ডলের ভাই আশরাফুল বাদী হয়ে ঝাউদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান কেরামত উল্লাহকে প্রধান আসামি করে ৭১ জনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এবং এই মামলার প্রধান আসামি কেরামত ৫ই মে-২০২২ইং র্যাবের হাতে আটক হয়।
অপরদিকে সংঘর্ষে নিহত রহিম মালিথার ছেলে রফিকুল বাদী হয়ে প্রতিপক্ষ আনিস মেম্বারকে প্রধান আসামি করে একই থানায় আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান পৃথক দুটি মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। নতুন করে সংঘর্ষ এড়াতে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে। আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানায় ওসি। তিনি আরো জানান, এই পর্য়ন্ত ১০জনকে আটক করা হয়েছে।