ধান উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী নওগাঁ জেলার সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। সম্প্রতি ধান উৎপাদনের পাশাপাশি উন্নত জাতের স্বুস্বাদু আম উৎপাদনেও নওগাঁ জেলা প্রথম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমের অগ্রযাত্রা ধানের উৎপাদনের উপর তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ধান উৎপাদনের জন্য অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমিগুলোই মুলত আমবাগানে রুপান্তরিত হয়েছে। মুলতঃ বিভিন্ন জাতের উন্নত মানের ধান উৎপাদনেই নওগাঁর সুখ্যাতি দেশজোড়া। ধানসহ অন্যান্য রবিশস্য উৎপাদনের উপরই জেলার মানুষের জীবণ ও জীবিকা আবর্তিত।
নওগাঁ জেলা বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত। ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ বরেন্দ্র এলাকা হিসাবে খ্যাত সাপাহার ও পোরশা উপজেলার পুরো অংশ এবং মহাদেবপুর, পত্নীতলা ও নিয়ামতপুর উপজেলার আংশিক অংশ ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ বরেন্দ্র এলাকা হিসাবে পরিচিত। চলমান জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ বরেন্দ্র এলাকার জমির মালিকরা ধানের পরিবর্তে আম বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে এবং আশাতীত সফলতা লাভ করেছে। এ সকল এলাকার বাহিরে অবশিষ্ট ৬টি উপজেলায় ব্যাপক ধান চাষ হয়ে থাকে। জেলার এ সকল অঞ্চলের মাটি ত্রি ফসলা হলেও অধিকাংশ কৃষক বছরে ২বার তথা আমন ও বোরো ধান আবাদ করে থাকে।
চলতি মৌসুমে নওগাঁ পত্নীতলা, মহাদেবপুর, বদলগাছী, ধামইরহাটসহ প্রায় সকল উপজেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিলো। মাঠের আধাপাকা বোরো ধান নিয়ে কৃষক ও মজুররা নানারকম স্বপ্নের জাল বুনন করেছিলো। কৃষকদের জীবণের সুখস্মৃতির অনেকটাই জুড়ে ছিলো মাঠের বোরো ধান। কিন্তু ধান ঘরে তোলার মুহুর্তে প্রকৃতি যেন থাবা বসায় কৃষকের স্বপ্নে। ধান কাঁটার মৌসুমের শুরু থেকেই কাল বৈশাখি ঝড়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আর ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে কৃষকের স্বপ্নে বাদ সাঁধে। পাকা ধান ঘরে তুলতে না পারার বেদনা কৃষক ও কৃষাণীর মুখে কালো ছায়া লেপন করে দিয়েছে। আদৌ তারা সঠিক সময়ে পাকা ধান ঘরে তুলতে পারবেন কিনা তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে উপজেলার পত্নীতলা, মহাদেবপুর ও বদলগাছী উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে মাঠের অধিকাংশ পাকা বোরো ধান বৃষ্টির পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোথাও কোথাও এক হিঁটু পরিমাণ পানিতে নেমে কৃষক ও মজুররা বোরো ধান কাটছেন। মাঠে ধান মাড়াইয়ের জায়গা না থাকায় সড়কের উপরই কৃষকরা বোঙ্গা (ধান মাড়াই করার যন্ত্র বিশেষ) দিয়ে ধান মাড়াই করছেন। এদিকে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হওয়ার কারণে সকল এলাকায় কৃষকরা একসাথে বোরো ধান ঘরে তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ায় দেখা দিয়েছে চরম মজুর সংকট। অধিকাংশ স্থানেই অর্ধেক ধানই কৃষকরা মজুরদের দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষেতের ধান কাঁটার পর শ্রমিকদের তিন ভাগের ২ভাগ ধান দিতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
মহাদেবপুর উপজেলার কালুশহর মাঠের এক হিঁটু পানিতে নেমে ধান কাঁটার সময় কথা হয় হাসান নামে এক কৃষকের সাথে। তিনি জানান, ৭বিঘা জমিতে তিনি বোরো ধান লাগিয়েছেন। ৪বিঘার ধান কাটতে পারলেও শ্রমিক সংকটের কারণে ৩ বিঘার ধান ঘরে তুলতে পারেননি। নিচু জমির ৫কাঠার জমির ধান শ্রমিকরা কাটবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই কাটছেন। গত ২দিন বৃষ্টি হওয়ায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়নি। পানিতে ডুবে থাকা ধান দ্রুত কাটা না গেলে সেখানেই গাছ গজিয়ে ধান নষ্ট হয়ে যাবে জানিয়ে এই কৃষক বলেন, অবশিষ্ট ৩ বিঘা জমির ধান কাটা নিয়ে তিনি চরম সংশয়ে রয়েছেন। তিনি যে চারবিঘা জমির ধান কেটেছেন তার বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে ১৮/২০মণ। যা গত মৌসুমে ছিলো ২৫/২৬মণ। বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ ধান ৯শত ৫০ টাকায় বিক্রয় হওয়ায় উৎপাদন খরচ উঠানোই কঠিন হয়ে পড়বে জানিয়ে এই কৃষক বলেন, যে সকল কৃষক জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধান লাগিয়েছেন তাদের বিঘা প্রতি ৫/৬ হাজার টাকা লোকশান গুনতে হবে।
এদিকে শ্রমিক সংকটকে পুঁজি করে মজুরী বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁরা। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে প্রতি মণ ধানের বিপরীতে শ্রমিকদের স্থান ও অবস্থা ভেদে ১৫-২০ কেজি ধান দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ কৃষকের মাঠের ধানের অর্ধেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে শ্রমিকের পেছনে। এর উপর আছে জমির মালিকের পাওনা। কৃষকরা ধার দেনা করে এবং দোকানীদের কাছ থেকে বাঁকী সার বীজ নিয়ে যে ফসল উৎপাদন করেছেন তা কিভাবে শোধ করবেন সে নিয়ে তাঁরা চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ জানান, চলতি মৌসুমে নওগাঁয় ১ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান লাগানো হয়েছে। ধানের ফলনও হয়েছিলো আশাতীত। কিন্তু প্রাকৃতিক দূর্যোগে অধিকাংশ জমির ধান মাঠে শুইয়ে পড়ায় ফলনের উপর কিছুটা প্রভাব পড়বে। এ পর্যন্ত জেলার ৬৫ শতাংশ জমির বোরো ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে বলেও তিনি জানান।