কান্তা কত কষ্ট পেয়েছিল আমি জানি না। বেশ কয়েকদিন কান্তাও নিরুদ্দেশ। পান্তুর মৃত্যুর সপ্তাহ দুয়েক পর কান্তা এসেছিল। সময়টাকে এমন লম্বা মনে হয়েছিল। বড় বড় ভাসা ভাসা চোখের নিচে কালি। এমন দুর্দান্ত একটা প্রেমিকা রেখে কারো মরে যাওয়াটা কোনোভাবেই মানা যায় না।
আমি তো বলতাম, অত সুন্দর মেয়ে, ওকে যেখানে সেখানে নিয়ে ঘুরিস না। দরকার হলে আমার বাসায় আয়। সারা দিন থাক। পান্তু প্রথম প্রথম রাজি হতো না। আমার বাসায় আমার বুড়া বাপ ছাড়া আর কেউ থাকে না। মা মারা গেছেন বছরখানেক হলো। বাপের অবস্থা ‘আজ থাকি’ তো ‘কাল যাই’। শরীরটা দুনিয়ার অসুখবিসুখের বাসা। তারপরও বেঁচে আছেন। সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকেন। আমি বলি, একটু কোথাও ঘুরে আসো না। ভালো লাগবে। শোনে না। বলেন, তোর বয়সে থাকতে সারা পৃথিবী ঘুরেছি। নিজে বলেননি কখনো। মায়ের কাছে শুনেছিলাম, মরিশাসে যেবার গিয়েছিল, এক ‘তন্বী তরুলতা বহ্নি-আঁখি’ নাকি আমার বাপকে দেখে একেবারে মাত। মা অবশ্য মেয়েটা যে অমন তা বলেননি। আমাদের অ্যালবামে মেয়েটার বেশ কয়েকটা ফটো ছিল। বলেছিলেন, তোর বাপকে দেখে তো এই বিদেশি মেয়ে এমন মজা মজেছিল। সে কি আর জানতো কী মাকাল ফল নিয়ে আমি জীবন কাটিয়ে দিলাম। সত্যিই আমার বাপের গায়ের রং, উচ্চতা মানে মাথায় লম্বাÑ আমরা কেউ পাইনি। মা তো একছার কালো। তবে ওই যে, সংসার সুখের হয় ঘরনির গুণে, এই কথা আমার বাপের জীবনে সত্য হয়েছিল।
আমার জীবনে তখন পর্যন্ত ঘরনির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পান্তুর মৃত্যুর জন্য আমার জীবনটাও দুম করে বদলে গেল।
কান্তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়-প্রেম হওয়ার পর পান্তু প্রায়ই বলতো, জানিস আমি মনে হয় জীবনে সব পেয়ে গেছি। আর বাঁচার কোনো সাধ নেই। হুট করে একদিন মরে যাবো।
আমি বলতাম, কী যা-তা বলিস।
পান্তু একদিন বলে, আচ্ছা একটা কথা বলি? ওর কণ্ঠে আকুতি ছিল।
কী কথা? আমিও একটু বিস্ময় নিয়ে কথাটা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে তাকাই।
পান্তু বলে, আমি মরে গেলে তুই কান্তাকে বিয়ে করিস।
আমি একেবারে বাস থেকে সোজা দাঁড়িয়ে যাই, কী পাগলের কথা।
পান্তু বলে, ওবাবা, এমন লাফ দিয়ে উঠলি কেন?
শান্ত কণ্ঠে বলি, আমার মতো এমন একটা কালো-হাবড়াকে কান্তা বিয়ে করবে না।
পান্তু বলে, ও, মনে মনে তাহলে ইচ্ছে আছে?
আমি বলি, থাকবে না কেন, কান্তার সঙ্গে তোকে প্রেম করতে দেখলে কে না জেলাস হয়।
পান্তু বলে, তুইও?
আমি বাস্তবতার কথা বলি, মিথ্যা কথা তোর সঙ্গে বলে আমার কী লাভ।
পান্তু তখন আরেকটা বিস্ফোরণ ঘটায়। বলে, কান্তার পেটে বাচ্চা এসে যেতে পারে। আমরা একদিনও কোনো কিছু ব্যবহার করিনি। আমি মরে গেলে তুই ওটা মেনে নিতে পারবি? পান্তু বলে চলে, কান্তা কখনো চায়নি কিছু ব্যবহার করি। আমি বলেছি, যদি কোনো কিছু হয়। কান্তা বলেছে, তাহলে বিয়ে তো করব। আমি বলেছি, যদি আমি মরে যাই। মানে ওই যে সিলসিলা ছবির মতো।
যদি মরে যাও তো আমি বিদেশে চলে যাবো। কান্তা বলেছিল।
পান্তু বলে, তাহলে তোমার মডেলিং, অ্যাক্টিংÑ এসবের কী হবে?
হবে না, কান্তা একেবারে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলেছিল।
পান্তু নাকি বলতে চেয়েছিল, ওর মুখেও এসে গিয়েছিল, কান্তা আসলে তাকে এত ভালোবাসে। কিন্তু তার বদলে বলেছিল, সিলসিলা ছবিতে তো বন্ধুই মেয়েটাকে বিয়ে করে, তাই না? আমিও তাই করব? পান্তুর বন্ধু বলতে আসলে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না।
পান্তুর আসল নাম জামশেদ পারভেজ। কান্তা ওকে জামশেদ বলে ডাকতো। আর সবাই ওকে পারভেজ নামেই ডাকত। কান্তার কথা সবাই যে নামে ডাকে সে নামে তো সে ডাকবে না। আর জামশেদ নামের ভেতরে একটা কেমন বাদশাহি ব্যাপার আছে।
আমি পান্তুকে বলেছিলাম, কান্তা তো ঠিকই বলেছে। পরে কান্তাকে বলে, তুমি আমাকে জামশেদ বলে ডেকো না।
কেন?
ওটা নাকি এক অভিশপ্ত বাদশার নাম।
কোথা থেকে পাও এসব?
পান্তু বলে, কার কাছে যেন শুনেছিলাম।
তাতে কি? তোমার মা-বাবা তোমার নাম রেখেছেন। এই নামের একটা লোক দুর্ভোগ পোহালো বলে তুমিও তা-ই পোহাবে নাকি? আমার কাছে তুমি জামশেদ।
না ডাকবে না।
কী সব ছেলেমানুষী!
তার কদিন পর কান্তার হঠাৎ কী একটা মনে হয় আর বলে, আচ্ছা তোমাকে না হয় আমি জামি করে ডাকব। চলবে?
তারপর আমাদের পান্তু কান্তার কাছে জামি হয়ে গিয়েছিল।
জামিকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ ছিল না। জামি কি কিছু করবেটরবে না? এভাবে ঘুরবে? আমার কাছে কান্তা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল।
আমি বলেছিলাম, তুমিই তো ওকে ঠিক করতে পারো। তোমার মতো মেয়ে যদি ওকে ঠিক করতে না পারে তো আর কে করবে।
পান্তুর এক মেয়েমানুষের কোনো নেশা ছিল না, এ ছাড়া সব ধরনের আজেবাজে নেশা ছিল। ওর মতো নষ্ট একটা ছেলে কী করে আমার বন্ধু হয়Ñ অনেকেই এই নিয়ে কথা তুলত। সরাসরি বলতো না, আকারে ইংগিতে বলতো। আমি গরু হলেও যেহেতু ঘাস খাই না, বুঝতে কষ্ট হতো না।
পান্তু বলে, যারা জগতে কিছু করতে পারে না তারাই ওই সব ক্যারিয়ারটেরিয়ার করে। সরকারি চাকরি, নয়তো কোম্পানি, কর্পোরেট কালচারে ঢুকে পড়ে। কান্তাকে বলেছিল। কান্তা যখন বলেছিল, ফাহিম ভাইয়া কি সুন্দর ভার্সিটি পাস করেই একটা গভর্নমেন্ট জব পেয়ে গেল। আর তোমার বয়স ত্রিশ হতে চললো তুমি কিছুই করতে পারলে না।
কান্তা তুমি কি চাও আমি ফাহিমের মতো নিজেকে বিকিয়ে দি? সারাক্ষণ বসের পাছায় তেল মাখাতে থাকি।
পান্তু এসব কথা আমার সামনেই বলতো। আমাকে সে নামও দিয়েছিল, ‘তেলু ফাহিম’। ভার্সিটিতে দুটো আর আগে দুটো ফার্স্টক্লাসÑ সবই বলে আমার ওই তেলমারার যোগ্যতায়ই পাওয়া।
আমি বলতাম, আমি কি খাতায়ও তেল মেখে দিয়েছি নাকি?
আরে ব্যাটা প্র্যাকটিক্যাল আছে না, ভাইভা আছে না। তুই আমারে কি মুরগি বোঝাও।
পান্তুর তুই-এর সঙ্গে ‘তুমি’ দিয়ে কথা শেষ করার বেমানান ব্যাপারটা নিয়ে আমি আর কান্তা দুজনেই খুব হাসতাম। পান্তু কান্তাকে নিয়ে একান্তে সময় কাটানো ছাড়া আমার বাসায় যতক্ষণ থাকত, মানে শনিবার, আমার সঙ্গে, মানে আমরা তিনজনেই আড্ডা দিতাম। আমি চাইতাম, পান্তু সব নেশাটেশা ছেড়ে কান্তাকে বিয়ে করুক। সংসার শুরু করুক। মৌসুমী আপু করছে না। কোনো তো সমস্যা নাই। কান্তা বলেছে, সে যেভাবে তার ক্যারিয়ার গুছিয়ে এনেছে, তার কোনো অসুবিধা হবে না বিয়ে করলেও। কান্তা কার সঙ্গে কী করে না করে তাতে পান্তুর কিচ্ছু আসতো যেত না। কী একটা সেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপনে কান্তা আর একটা ছেলে এমন খোলামেলা পোশাকে ছিল। খালি গায়ে থাকা জিনসের প্যান্ট পরা ছেলেটাকে পেছন থেকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরা কান্তা। ছেলেটা কান্তার ঊরু তলার নিচে হাত দিয়ে কান্তার একটা পা সামনে দিকে টেনে ধরে রেখেছে। কান্তার হাঁটুটা স্পষ্ট বেরিয়ে আছে। সেই পায়ে পেছন থেকে ছেলেটাকে বেড় দিয়ে ধরেছে কান্তাÑ এমনই ছিল বিজ্ঞাপনটাÑ পান্তু দেখে বলে, তোমার মতো মেয়ের সঙ্গে এমন একটা ম্যান্দামারা পোলা দিল!
কান্তা বলে, তোমার মতো হ্যান্ডসাম কোনো ছেলেকে পেল না তো কী আর করার। আসলেই, পান্তু একটু বেশিমাত্রায় সুদর্শন আর ততটাই ম্যানলি।
আমার দাদা ছিলেন ও রকম সুপুরুষ। আমার দাদা বলতে গেলে আমার বাপের চেয়ে কয়েকগুণ সুদর্শন ছিলেন। তেমনই নাকি দেখতে ছিল আমার দাদি। কিন্তু তারপরও আমার চাচা আর ফুপুরা কেউ তাদের মা-বাপের মতো অতটা সুন্দর হয়নি, আবার কমও হয়নি। আর আমার তিনটা বোন যদিও কিছু পদের, আমার তো কোনো সুরতই নেই। একে কালো, তায়ে খাটো। তারওপর মাথায় টাক পড়েছে। মা আমাকে নিয়ে দুঃখ করতো কি না জানি না। আমাদের জ্ঞাতি-গুষ্টিতে আমার মতো কালো আর একটা লোকও নেই। গ্রামে গিয়ে আমাকে যখন খন্দকার বাড়ির বড় জনের বড় ছেলে বলে পরিচয় করানো হতো, অনেকের চোখেই কেমন যেন একটা ভাব ফুটে উঠতে দেখতাম। আমার ছোট দাদি তো বলতো, খোনাকারবাড়ির ছাওয়াল এমন কালো অল কী কইরে!
সেই আমার মতো এমন একটা লোককে পান্তু বলে গেছে কান্তাকে বিয়ে করার জন্য। অবশ্য কান্তা আর পান্তুর ব্যাপারটা জগতের আর কেউ জানতো না। কান্তার মডেলিং আর অভিনয়ের রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্য ওদের সম্পর্কের ব্যাপারটা গোপনে গোপনেই চলতো। আর কান্তা সাংবাদিকদের এত ভালো মতো সামাল দিতে পারতো বা পারেÑ তা বলবার মতোই না, অন্যদেরও শেখার মতো বলেই মনে হয়। অবশ্য কান্তা বলে, এই লাইনে যারা টিকে থাকতে চায়, তাদের সবাইকেই এসব শিখেটিখে নেওয়া লাগে। শিখতে থাকা মানেই টিকতে থাকা, টিকতে থাকা মানে টিকে যাওয়া।
‘টিকতে থাকা’র সঙ্গে যে ‘শিখতে থাকা’র সম্পর্ক সেটা নতুন করে আমি জেনেছিলাম। কান্তা বলতো, ওর সাকসেসের একটাই থিওরিÑ ‘নিজেকে শেখাও।’ এর সঙ্গে বাকি দুটো আপনাআপনিই যোগ হয়ে যায়Ñ ‘নিজেকে বোঝাও।’ ‘নিজেকে নিজের কাজে লাগাও।’
কান্তা আমাদের তুলনায়, মানে আমার ও পান্তুর তুলনায় বছর পাঁচেকের ছোট। কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধিতে মনে হতো আমাদেরও বড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাস করেই পান্তুর কপালে কী করে কান্তা জুট গেলÑ সে এক কাহিনী। অবশ্য তেমন কোনো বড় কাহিনি না। আমি তো তার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন।
কক্সবাজারে একটা বিজ্ঞপনের শুটিং করতে গিয়ে কান্তা পানিতে আরেকটু হলে ডুবে মরতো। পান্তু সেদিন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কান্তাকে বাঁচিয়েছিল। কান্তা ততক্ষণে তো অজ্ঞান। পান্তু মেয়েটাকে তুলে এনে, কিছুই যেন হয়নি, এমন নির্বিকারভাবে আমাকে বলেছিল, চল। আমি কী মনে করে থেকে গিয়েছিলাম। অমন ভেজা শরীরে কান্তার মতো রূপবতী দেহবতী নারীকে এত কাছ থেকে তো কোনোদিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। জ্ঞান ফিরে আসা পর্যন্ত আমি ছিলাম। কান্তা যখন জানে যে আমার বন্ধু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে বাঁচিয়েছেÑ তারপর ওর চোখেমুখে কেমন একটা ভাব জেগে ওঠে। কোনো উত্তেজনা তার চোখেমুখে ছিল না।
তারপর আমাকে ধরেই, আমি কোথায় যাই কি করি, এসব বের করেই ঠিকই একদিন পান্তুকে খুঁজে বের করে। তারপর তো কত কী! পান্তু তো কতোবার পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। আমার জন্য পারেনি। কান্তাকে কত যে যা-তা বলে গালাগালি। বলেছিল, সে এমন এক জায়গার মাল সেখানে তার মতো মালের যাবতীয় চুলকানি মেটানোর লোকের কোনো অভাব নাই। সেখান থেকে কাউকে বেছে নেয় না কেন। পান্তুকে আমি অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি, বিষয়টা শরীরের না, মনের, মানে প্রেমের, মেয়েটা সত্যিই তাকে ভালোবাসে। আর সে মোটেও অযোগ্য ছেলে না, কোনো মেয়ের জন্যই অযোগ্য না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পান্তু কোনো প্রেম করেনি, নেশা করে কাটিয়েছে। কলেজ জীবন থেকেই নানান ড্রাগ নিয়ে নিজের ওপর বিচিত্রসব এক্সপেরিমেন্ট করেছে। নেশা ছিল ওর সময় কাটানোর জগত। কীভাবে কীভাবে কোনো অবস্থাতেই নেশা তাকে খেতে পারেনি। এর মূল ব্যাপারটা অবশ্য আমি ভালো করেই জানতাম। পান্তুর মা তার বাপকে ছেড়ে হঠাৎ করে একটা অল্প বয়সী লোকের সঙ্গে যে ভেগে গেছেÑ এটা সে কোনোদিনও মানতে পারেনি। মেয়েদের সে বিশ্বাস করে না। অনেক কষ্টে পান্তুকে কান্তার দিকে ফিরিয়েছিলাম, এই আমিই। কান্তাকে পান্তু বলেছিল, সে অত্যন্ত পচা একটা ছেলে। সে মেয়েদের মোটেও দেখতে পারে না।
কান্তা ততদিনে আলিফলায়লার শহরজাদি বা সাগরিকার ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে। সে নায়িকা/মডেল হলেও তার মনের মতো পুরুষকে সে খুঁজে পেয়েছে, এই ধারণা থেকে সে পান্তুকে সময় দিতে শুরু করে। বিভিন্ন জায়গায় আমাকেসহ দেখা করতে শুরু করে। দুজনকে দেখা করিয়ে দিয়ে আমি কিছুক্ষণের জন্য লাপাত্তা হয়ে যেতাম। তারপর কান্তার মোবাইল থেকে একটা ফোন আসতো। তারপর আমি আবার হাজির হতাম। কান্তা আগে বেরিয়ে যেত, তারপর আমরা। পরে আমার বাসায় ওদের অভিসার হতো একেবারে সকাল বেলা। সময়টা ছিল সকাল ৮টা থেকে ১০টা। চাইলে সারাদিনই কাটাতে পারতো। কিন্তু কান্তা তার কোনো শিডিউল মিস করতো না। পান্তুও চাইতো না।
আমাকে পান্তু তারপরও বলেছিল, কান্তা যে কী পেল আমার ভেতরে জানি না।
তুই সেদিন ওকে বাঁচাতে গিয়েছিলি কেন?
পান্তু বলেছিল, আসলেই জানি না। মনে হয়েছিল, আর গেলাম। মাঝে মাঝে সত্যিই, কার সুতার টানে-যে আমরা পড়ে যাই, তাই না দোস্ত।...আচ্ছা আমাদের সব কিছু হোকÑ এটা তুই চাস কেন, দোস্ত? আমি বলি, আমি না তোমাদের মতো সুন্দর মানুষের মিল কেবল সিনেমাতেই দেখেছি। তুই যেমন নায়ক, কান্তা তো কান্তাই। এমন আর একটাও নাই দোস্ত। তোমাদের দুইটারে আমার দেখতেও সুখ লাগে। পান্তু বলত, আমি এখনও চাই কান্তা আমাকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে চলে যাক। আমার সঙ্গে থাকলে ওর জীবনটা সুখের হবে না।
আমি বলি, নাকি তুই সেই থিওরি অ্যাপ¬লাই করেছিস, ‘যাকে ভালোবাসো তাকে মুক্ত করে দেও।’
থিওরি! আমি? এসব তো জীবনেও শুনিনি দোস্ত। আমার জীবন তো থিওরিতে চলে না। কারো জীবনই চলে না, তবে জীবন থেকে নাকি অনেক থিওরি বের করা যায়। আমার জীবন শালা এমন ছ্যারাবেরা, এখান থেকে কিছুই বের করা যায় না।
আমি বলি, তুই তো শালা ভালোবাসাটা পেয়েছিস। তোর জীবন ধন্য।
পান্তু তারপর যা বলেছিল আমি হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলাম। ও বলে, ভালোবাসা সত্যিই পেয়েছি দোস্ত। কিন্তু আমি যে ভালোবাসা বাসতে পারি না। মানুষ যেমন নানান বিষয়ে প্রতিবন্ধী হয়, আমি হলাম ভালোবাসা বিষয়ে প্রতিবন্ধী। আই অ্যাম ডিসাবল টু লাভ এনি উইম্যান।
তার মানে কী? তুই কান্তাকে ভালোবাসিস না।
আমি তো উত্তরটা দিয়েইছি। আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আমি বলি, তাহলে?
তাহলে আর কী, কান্তা আমাকে ভালোবেসে সুখ পায়, ভালোবেসে যে সুখ পায়, ভালোবাসা তো তার। অন্য ভালোবাসলো কি না বাসলো, তাতে কী আসে যায়। কান্তাকে বহুবার ভেবেছি কথাটা বলব, তারপর হঠাৎ একদিন এই কথাটা মনে হয়, ভালোবেসে যে সুখ পায়, ভালোবাসা তার ভেতরেই থাকে।
আমি বলি, এটাও বুঝিস দেখছি।
পান্তু বলে, দোস্ত এটা কোনো আবিষ্কার নয়। আমি জগতের সব মানুষকে ভালোবাসতে পারি। কিন্তু প্রেম মানে যে, বিশেষ একটা মেয়ের প্রতি ভালোবাসাÑ সেই প্রেম নামের বস্তু আমার কোনো মেয়ের প্রতি জাগেনি, জাগে না। আমার মতো লোক ভালোবাসতে পারে না।
আমি বলতে পারতাম, অভিশপ্ত বলে যদি কিছু থাকে তো সেই হলো ওই ব্যক্তি, যে ভালোবাসতে পারে না। লোকে তো বলে ভালোবাসা হলো একটা কল্পিত বিষয়, আসল বিষয় হলো যা ঘটে, যা বাস্তবতাÑ হিংসা, প্রতারণা, সেক্স, হত্যা, ধর্ষণ, আর বিশ্বাসঘাতকতা। মানুষ কিছু ভালো ধারণা তৈরি করেছে প্রেম, মায়ামমতার নামেÑ এসবই আদর্শস্তরের ব্যাপার। আইডিয়া আর আইডিয়াল এই দুই জিনিস কত রথী-মহারথী গুলিয়ে ফেলেন, আমরা তো কোন ছার।
পান্তুকে এসব বলতে পারতাম। অবশ্য বলে কোনো লাভ নেই। আর কান্তার সঙ্গে তো আলাদা কথা বলার মতো, না তার সময় আছে, না আমার। কান্তা চেয়েছিল, নিজের ফ্ল্যাট, একটা গাড়ি আর ব্যাংকে কোটি খানেক টাকা জমাতে পারলেই সে পান্তু বা জামিকে বিয়ে করবে। অভিনয়টভিনয়ও কমিয়ে দেবে। পান্তুর অবশ্য কান্তাকে বিয়ে করার জন্য কোনো ব্যস্ততা ছিল না। প্রথমদিকে অনেকদিন কান্তার শরীরে নিজেকে ভুলে থাকলেও পরে তার মনে হয়েছে, সে এতদিন একটা ঘোরের ভেতরে ছিল। পান্তু আমাকে বলতো, তোর কী মনে হয় জানি না, আমার তো মনে হয় আমি যে দেশে যে সমাজে যে ধর্মে জন্মেছি, যে ভাষায় জন্মেছি, সবই ভুল। আমার এখানে জন্ম না হলে, আমার ভাষা যদি বাংলা না হয়ে চেক ভাষাও হতো, আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম। আমরা যে নিজেদের দেশ-সমাজ আরও কি সব নিয়ে এত আবেগ দেখাইÑ এসবই বোগাস। কোনো মানে নেই। তুই ভালো ইংরেজি শিখেছিলি বলেই তো তোর চাকরিটা হলো। আমিও মনে করি তাই হওয়া দরকার। এমনকি এশীয় ভাষাগুলো যেমন আরবি, ফারসি, হিন্দি, চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান, থাই, মালে আরো যা যা আছে পারলে শেখা দরকার। ভালো মতো করে শেখা দরকার।
পান্তুর এই ধরনের কথাবার্তা খুবই খাপছাড়া মনে হতো। আগে কখনোই এই জাতীয় কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না। পান্তুটার কোথায় যেন একটা বদল ঘটেছে। মাঝে মাঝে গায়েব হয়ে যাওয়াটা ছাড়া আর কোনো কিছুতে মিল পেতাম না। তারপর তো নিজের মরার কথা বলা শুরু করল হঠাৎ। বলে দিল, কান্তার পেটে তার বাচ্চা এসে যেতে পারে, কান্তা তো এতদিনেও তিন কোটি টাকা জামাতে পারেনি। এক কোটিতে একটি ফ্ল্যাট, এক কোটি ব্যাংকে আর এক কোটিতে গাড়ি কেনা, বিশ লাখ টাকা গাড়ির মেন্টেনেন্সের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট। মানে গাড়ির পেছনে প্রতিমাসে ড্রাইভারসহ আরো সব খরচ বাবদ লাগবে তার জন্য আর কি আগাম সঞ্চয়।
আমি বলতাম, তুই কী সব মরার কথা বলা শুরু করলি। পান্তু বলত, কারণ আমার এই জীবনে আর কিছু পাওয়ার নাই। আমি বলতাম, কান্তার কী হবে? তার জন্য তো তুই আছিস। আচ্ছা তুই মনে মনে কান্তাকে ভালোবাসিস না?
আমিও দুম করে বললাম, বাসি। তোকে যেমন বন্ধু হিসেবে ভালোবাসি, কান্তাকেও তেমনি বাসি।
ওই একই কথা। ভালোবাসা তুই যে হিসাবেই বাসিস না কেন, ভালোবাসলেই হলো। ‘ভালোবাসলে সব হবে’Ñ না ‘বেঁচে থাকলে সব হবে’Ñ কার জানি একটা কবিতার লাইনে এমন একটা কথা আছে। অনেক আগে শুনেছিলাম, কোনোভাবেই মনে করতে পারলাম না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর? তার তো কোনো কবিতাই আমি পড়িনি, শুনিও নি। যাই হোক আমি পান্তুকে দ্বিতীয় কথাটা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু পান্তু তো কোনো কিছুই চায় না। তার কী হবে না হবে, কোন আশায় সে দিন কাটাচ্ছে, এমন তো কোনো কিছুই আমি জানি না। জানি না মানে আজ অব্দি জানতে পারিনি।
পান্তুদের ঢাকা শহরে ছয়তলা একটা বাড়ি আছে। দুই ভাই, এক বোন। ভাইটা ইঞ্জিনিয়ার, বোনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। মাঝখানে পান্তুটাই বিগড়ানো। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে তো অন্যদুটো ভাইবোনকে উল্টেপাল্টে দেয়নি। পান্তু বলে, তুই দেখবি যে ফ্যামিলির সবগুলো গুণীর তার ভেতরে একটা থাকে প্রবলেমেটিক। আবার যে ফ্যামিলিতে সবগুলো বদের হাড্ডি তার ভেতরে একটা থাকে পুরো উল্টা। তাছাড়া আমি যেটা মনে করি তা হলো, কিছুতেই কিছু যায় আসে না। (আমার বলতে ইচ্ছে করতো, তাহলে তোর মায়ের ব্যাপারটা নিয়ে তুই এত ভুগে যাচ্ছিস কেন?) চেষ্টা করেও মানুষ জগতে খুব বেশি কিছু করতে পারে না। কদিন বাঁচার দরকার ছিল, বেঁচে গেলামÑ এই তো। আমি গুণী পরিবারের ওর্থলেস ছেলে। আমার দ্বারা তো কিছু করা সম্ভবও নয়; করতেও চাই না।
পান্তুর কথা সেদিন কাকে যেন বলছিলাম, সে বললো, এ তো দেখি ইউ.জি. কৃষ্ণমূর্তির আরেকটা কনসাইজ সংস্করণ। তারপর ইউ.জি. কৃষ্ণমূর্তির ব্যাপারটা কী একটু-আধটু জানলাম। আমার মাথায় তেমন কিছু ঢুকেনি, কেবল এটা বুঝলাম, তারা যা বলছে, তাতে স্রেফ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া মানুষের আর তেমন কিছু করার নেই। সবকিছুই ধারণামাত্র। চিন্তা হলো সমস্ত গ-গোলের উৎস। চিন্তার মতো বাজে জিনিস আর নাই।Ñ এইসব।
আবার এও শুনলাম যেখানে সবকিছু ব্যর্থ হয়ে যায়, সেখানে একমাত্র প্রেমটাই, ভালোবাসাটাই কাজ করে। ভালোবাসা হলো তুরুপের তাস।Ñ এসব আমার মাথার মধ্যে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই সরে গেছে। কারণ এর মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই কদিনের জ্বরে ব্রেনহেমারেজ হয়ে পান্তু নিজের ঘরে একা একা মরে পড়ে রইল। নিজেদের ছয়তলা বাড়ির দোতলার বাম পাশের ফ্ল্যাটে একটা রুম নিয়ে থাকত। মেসের মতো বাকি রুমগুলোতে বামপন্থী পার্টি করা সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে থাকত। চাইলে কোনো সময় কিছু টাকা বা বাজারটাজার করার করে দিত। পান্তুর তো কোনো ঠিক ঠিকানা ছিল না। বারোটা ফ্ল্যাটের তিনটার ভাড়া তো সে পেত। তাও জমা রাখত ভাবির কাছে। দরকার হলে নিত, না হলে পড়েই থাকত।
যে জ্বরে ভুগে মারা গেল, যে কদিন ভুগেছিল, ফোনও ছিল বন্ধ। আর কান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার একটা শর্ত ছিল, কোনোদিন সে তাদের বাসায় যেতে পারবে না, যদি পান্তু তাকে নিজের সঙ্গে করে না নিয়ে যায়। আর দেখা হওয়ার দিনগুলো ছাড়া কখনোই তাকে ফোন করা যাবে না। আরো কত শর্ত দিয়ে যে কান্তাকে সম্পর্কটায় সম্পর্কহীন করে রেখেছিল তার বলে কোনো হিসাব নেই। এত শর্ত দিয়ে সম্পর্ক প্রেম কি, কোনো কিছুই বেশিদিন চালানো যায় না। তবু দেখতে দেখতে তাদের প্রেমের বয়স বছরখানেক পার হয়ে গিয়েছিল। ত্রিশে তখনও পড়েনি পান্তু। আমিও না। তারপর তো ত্রিশতম জন্মদিনের কদিন আগেই মারা গেল পান্তু। তারপরের ঘটনা আরো অদ্ভুত যে আমি এসবের কিছুই জানতাম না।
মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন পর কান্তা এলো একেবারে বিধবার মতো। এসে একটা খাম দিল। সেটা পান্তুর সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র। তাও ফরেন সার্ভিসে। আমি বিস্ময়ে হতবাক। তাহলে পান্তু যে অজ্ঞাতবাসে চলে যেত, সে কি তলে তলে এ-ই করেছে। আর কান্তা বললো, আরো একটা খবর আছে। এমন থমথমে ভাব ছিল। আমি কোনো মতে বললাম, কী। দুইটা চিঠি লিখে গেছে। কান্তা ওর পার্সের ভেতর থেকে দুটো চিঠি বের করে দিল। একটা আমাকে লেখা, অন্যটা কান্তাকে। আমি পড়ে আরেক দফা চমকে উঠলাম। পান্তু যে বাঁচবে না তা আগাম বলে গেছে। মরে গেলে আমি যেন কান্তা ও তার বাচ্চার দায়িত্ব নেইÑ সেটা জোর দিয়ে বলে বারবার সেখানে লেখা। কান্তাকে সে লিখেছে যদি আমাকে সে বিয়ে করে তাহলে সে মরেও শান্তি পাবে। মাত্র দুটো কথা লেখা, কান্তা লিখে কমা দিয়ে পরে প্যারা করে লিখেছে : ফাহিমকে বিয়ে করো। তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো। ব্যস আর কিছু নাই।
হাতে সময় বেশি ছিল না। তিন কোটি টাকা জমলো কি না সেটা হিসাব করার মতো সময় কান্তারও ছিল না। কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। আর কান্তা তো কোনোভাবেই গর্ভপাত করতে রাজি ছিল না। জিজ্ঞাসা না করলেও এটা বুঝতে কষ্ট হয়নি। বাচ্চাটার দায়িত্ব আমাকে নিতেই হবে। এদিকে আমাকে নেদারল্যান্ডসে যেতে হবে একটা ট্রেনিংয়ের জন্য। কোনোমতে আখত করে আমি রওনা দিয়েছিলাম। তারপর থেকে তো সংসার চলছে। মাঝে মাঝে পান্তুর কথাটা মনে বেজে ওঠে, ‘যে ভালোবাসে সুখটা তারই।’ সেই সূত্রটার খাপেমাপে আমি ভালোই এঁটে গিয়েছিলাম। কান্তা আমাকে নিয়ে সুখী কি না, আমাকে ভালোবাসে কি নাÑ আমি জানি না। জানতেও চাই না। আর কান্তাও তো কখনো বলেনি। হয়তো কোনোদিনই বলবে না।